আজ দৈনিক ভোরের কাগজে ঈদ নিয়ে গল্প.......শনিবার, ২৫ জুন ২০১৬
অপূর্ণতা
** সোহানুর রহমান **
শহরে ঈদ আসে না, দালানের জন্য দেখা যায় না ঈদের খুশির চাঁদটাকে। ডায়রির পাতায় এসব লিখতে থাকে রেজা। গ্রাম থেকে এসেছে অনেক দিন হলো। ঢাকায় এসে কোনো চাকরি না পেয়ে শেষে শুরু করে হকারি। বাসে বাসে বিক্রি করে আদর্শলিপি বই। ব্যবসা খারাপ না, ভালোই দিনগুলো যাচ্ছে। টুনটুনির জন্য মনটা খুব পোড়ে। সেই ক্লাস সিক্স থেকে প্রেম তারপর কতশত সুখের স্মৃতি। অনেকটা বছর কেটে গেছে এরই মধ্যে। টুনটুনি অবশ্য ওর আসল নাম না রেজা ভালোবেসে ডাকে, ভালোলাগে তাই। ডায়রিতে আরো কিছু লিখতে যাচ্ছিল কিন্তু মাথায় আসছে না। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, তাই বের হওয়া যাচ্ছে না। মায়ের জন্য এরই মধ্যে ঈদের শাড়ি কিনে ফেলেছে।
ঘরে অসুস্থ বাবা তার জন্যও কেনা হয়েছে লুঙ্গি, টুনটুনির জন্য কেনা হয়েছে মাথার ক্লিপ, চুড়ি ইত্যাদি। কেবল নিজের জন্যই কিছু কেনা হয়নি এখনো। জানালা দিয়ে আবার বাইরে তাকায়, আজ আর বের হতে পারবে কিনা সন্দেহ। পকেট থেকে বের করে টুনির চিঠিগুলো, এগুলো সব সময় ওর সঙ্গে থাকে। সুযোগ পেলেই পড়তে শুরু করে। আঁকাবাঁকা গ্রামের মেঠো পথের মতো হাতের লেখা। পিনআপ করা একটা স্ট্যাম্প সাইজ ছবিও আছে। সবকিছু পুরনো কিন্তু কথাগুলো যেন হৃদয়ে বাজে বিষের বাঁশির মতো।
২.
প্রতিদিন ফ্যাশন হাউসটার সামনে দিয়ে বাসায় ফিরতে হয় রেজাকে। ডলের গায়ে ঈদের বাহারি রঙের পোশাক। পাশাপাশি দুটো ডল, একটা মেয়ে একটা ছেলে যেন প্রেমিক-প্রেমিকা। রেজা হাসে, ভালোলাগে ওর কাছে। ডলের গায়ের জামাটার দাম কত সেটা নিয়ে টেনশনে ভোগে। এমন সুন্দর একটা জামা যদি টুনটুনি পড়ে, তাহলে কেমন লাগবে? গ্রামের মেয়েটি, কাজ করতে করতে যার শরীর ঘামে ভিজে যায়। রোদে জ্বলে কাপড়ের রঙ নষ্ট হয়ে যায়, সে হয়তো এতো দামি জামা কখনো পড়েনি। ইস যদি দিতে পারতাম তাহলে অনেক খুশি হতো। কিন্তু পকেটের কথা ভেবে আর দাম জিজ্ঞেস করা হয় না রেজার। হকারির কাজ কোনো বোনাস নেই, নির্দিষ্ট কোনো বেতন নেই। কেবল টার্গেট পূরণ করতে পারলেই কিছু ইনকাম। মনের ইচ্ছে মনে রেখে কাজে যায় আবার ফিরে। দিনে দু’বার তাকায় জামাটার দিকে। এভাবেই দিন কাটে রাত আসে। ঈদও ক্রমে কাছে চলে আসে।
৩.
সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে জামাটা কিনে রেজা। এবার বাড়িতে গিয়ে মাকে দিয়ে প্রস্তাব পাঠাবে টুনিদের বাড়িতে। আর শহরে ফিরবে না। এখানকার মানুষগুলোও কেমন ইট পাথরের। কেউ কারো প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ায় না গ্রামের মতো। মায়ের জন্য ঈদের কাপড় এবং বাবার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনে। সন্ধ্যায় চলে যায় কমলাপুর স্টেশনে। ঈদে ঘরে ফেরা মানুষের ভিড়। একজন লোক এসে রেজাকে বলল, টিকেট তো পাবে না। তবে চাইলে আমি তোমাকে ছাদে ব্যবস্থা করে দিতে পারি। এর আগে কখনো ট্রেনের ছাদে ওঠেনি রেজা। তবুও বাড়ি ফেরার ইচ্ছেটা ওকে বাধ্য করল। কিছু টাকা দিল লোকটাকে। তারপর সেই ব্যবস্থা করে ছাদে তুলে দিল। মাকে ফোন করে জানাল আসছে।
ট্রেন ছাড়ল দেড় ঘণ্টা লেটে। কেমন যেন একটু দুলছিল প্রথমে তারপর ঠিক হয়ে যায়। রেজা বসে থাকে অন্য সব মানুষের সঙ্গে। রাতের অন্ধকার চিরে চলছে ট্রেন। কেমন ঘুম ঘুম প্রায় রেজার, আবার জেগে ওঠে। ঘুমালে ঝুঁকি আছে ট্রেনের ছাদে। চোখে-মুখে অন্যরকম স্বপ্ন এইতো আর কয়েক ঘণ্টা। তারপরই বাবা-মা আর টুনিকে দেখবে সে। বিয়ে করে এবার সংসারী হবে। খেতে-খামারে কাজ করে সংসার চালাবে, টুনির সঙ্গে সুখে দিন কাটাবে। মনের আকাশ জুড়ে সেই সুখের তারাগুলোই যেন জ্বলে ওঠে বারবার। হঠাৎ ঝড় শুরু হয়, ভয়ঙ্কর ঝড়। রেজা আঁকড়ে ধরে থাকে অন্য মানুষদের হাত। বাতাস এতটাই জোরে বইছিল যে নিয়ন্ত্রণ রাখা বড় দায়। ভয়ে কয়েকজন চিৎকার করতে থাকে। রেজা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায়। হাতে থাকা ব্যাগটা ফসকে যায় সেটা ধরতে গিয়ে হঠাৎ পিছলে পড়ে যায় ট্রেনের ছাদ থেকে। কানে কেবল ভেসে আসে কিছু মানুষের চিৎকার আর ট্রেনের শব্দ। তারপর সব নিশ্চুপ।
৪.
রেজাদের বাড়ির পাশ দিয়েই ট্রেন যায় কিছুদূর গেলেই স্টেশন। রেজার মা ছেলের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে দরজার সামনে। বাবা একটু পর পর কাশি দিয়ে উঠে বলে, কই ছেলেটা এল?। টুনি কারণে-অকারণে ঘোরাফেরা করে রেজাদের বাড়ির আশপাশে কিন্তু রেজা আসে না। দিন ফুরিয়ে রাত হলো, আকাশে উঁকি দিলো ঈদের চাঁদ কিন্তু তার সোনামাণিক এখনো ফেরেনি ঘরে। রেজার মা তাকিয়ে থাকে পথের দিকে। কিন্তু রেজার মতো কেউ আসে না। অজানা ভয়ে তার চোখের কোণে জল চিকচিক করে। মনে প্রার্থনা করে সৃষ্টিকর্তার কাছে ছেলের যেন কিছু না হয়। কয়েকটা জোনাক পোকা কেবল পথের এপাশ থেকে ওপাশে ছোটাছুটি করে। ঠিক সেই মুহ‚র্তে একটা লাশবাহী অ্যাম্বুলেস এসে ঢুকে রেজাদের বাড়িতে।
— অপূর্ণতা
** সোহানুর রহমান **
শহরে ঈদ আসে না, দালানের জন্য দেখা যায় না ঈদের খুশির চাঁদটাকে। ডায়রির পাতায় এসব লিখতে থাকে রেজা। গ্রাম থেকে এসেছে অনেক দিন হলো। ঢাকায় এসে কোনো চাকরি না পেয়ে শেষে শুরু করে হকারি। বাসে বাসে বিক্রি করে আদর্শলিপি বই। ব্যবসা খারাপ না, ভালোই দিনগুলো যাচ্ছে। টুনটুনির জন্য মনটা খুব পোড়ে। সেই ক্লাস সিক্স থেকে প্রেম তারপর কতশত সুখের স্মৃতি। অনেকটা বছর কেটে গেছে এরই মধ্যে। টুনটুনি অবশ্য ওর আসল নাম না রেজা ভালোবেসে ডাকে, ভালোলাগে তাই। ডায়রিতে আরো কিছু লিখতে যাচ্ছিল কিন্তু মাথায় আসছে না। বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে, তাই বের হওয়া যাচ্ছে না। মায়ের জন্য এরই মধ্যে ঈদের শাড়ি কিনে ফেলেছে।
ঘরে অসুস্থ বাবা তার জন্যও কেনা হয়েছে লুঙ্গি, টুনটুনির জন্য কেনা হয়েছে মাথার ক্লিপ, চুড়ি ইত্যাদি। কেবল নিজের জন্যই কিছু কেনা হয়নি এখনো। জানালা দিয়ে আবার বাইরে তাকায়, আজ আর বের হতে পারবে কিনা সন্দেহ। পকেট থেকে বের করে টুনির চিঠিগুলো, এগুলো সব সময় ওর সঙ্গে থাকে। সুযোগ পেলেই পড়তে শুরু করে। আঁকাবাঁকা গ্রামের মেঠো পথের মতো হাতের লেখা। পিনআপ করা একটা স্ট্যাম্প সাইজ ছবিও আছে। সবকিছু পুরনো কিন্তু কথাগুলো যেন হৃদয়ে বাজে বিষের বাঁশির মতো।
২.
প্রতিদিন ফ্যাশন হাউসটার সামনে দিয়ে বাসায় ফিরতে হয় রেজাকে। ডলের গায়ে ঈদের বাহারি রঙের পোশাক। পাশাপাশি দুটো ডল, একটা মেয়ে একটা ছেলে যেন প্রেমিক-প্রেমিকা। রেজা হাসে, ভালোলাগে ওর কাছে। ডলের গায়ের জামাটার দাম কত সেটা নিয়ে টেনশনে ভোগে। এমন সুন্দর একটা জামা যদি টুনটুনি পড়ে, তাহলে কেমন লাগবে? গ্রামের মেয়েটি, কাজ করতে করতে যার শরীর ঘামে ভিজে যায়। রোদে জ্বলে কাপড়ের রঙ নষ্ট হয়ে যায়, সে হয়তো এতো দামি জামা কখনো পড়েনি। ইস যদি দিতে পারতাম তাহলে অনেক খুশি হতো। কিন্তু পকেটের কথা ভেবে আর দাম জিজ্ঞেস করা হয় না রেজার। হকারির কাজ কোনো বোনাস নেই, নির্দিষ্ট কোনো বেতন নেই। কেবল টার্গেট পূরণ করতে পারলেই কিছু ইনকাম। মনের ইচ্ছে মনে রেখে কাজে যায় আবার ফিরে। দিনে দু’বার তাকায় জামাটার দিকে। এভাবেই দিন কাটে রাত আসে। ঈদও ক্রমে কাছে চলে আসে।
৩.
সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে জামাটা কিনে রেজা। এবার বাড়িতে গিয়ে মাকে দিয়ে প্রস্তাব পাঠাবে টুনিদের বাড়িতে। আর শহরে ফিরবে না। এখানকার মানুষগুলোও কেমন ইট পাথরের। কেউ কারো প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়ায় না গ্রামের মতো। মায়ের জন্য ঈদের কাপড় এবং বাবার জন্য প্রয়োজনীয় ওষুধ কিনে। সন্ধ্যায় চলে যায় কমলাপুর স্টেশনে। ঈদে ঘরে ফেরা মানুষের ভিড়। একজন লোক এসে রেজাকে বলল, টিকেট তো পাবে না। তবে চাইলে আমি তোমাকে ছাদে ব্যবস্থা করে দিতে পারি। এর আগে কখনো ট্রেনের ছাদে ওঠেনি রেজা। তবুও বাড়ি ফেরার ইচ্ছেটা ওকে বাধ্য করল। কিছু টাকা দিল লোকটাকে। তারপর সেই ব্যবস্থা করে ছাদে তুলে দিল। মাকে ফোন করে জানাল আসছে।
ট্রেন ছাড়ল দেড় ঘণ্টা লেটে। কেমন যেন একটু দুলছিল প্রথমে তারপর ঠিক হয়ে যায়। রেজা বসে থাকে অন্য সব মানুষের সঙ্গে। রাতের অন্ধকার চিরে চলছে ট্রেন। কেমন ঘুম ঘুম প্রায় রেজার, আবার জেগে ওঠে। ঘুমালে ঝুঁকি আছে ট্রেনের ছাদে। চোখে-মুখে অন্যরকম স্বপ্ন এইতো আর কয়েক ঘণ্টা। তারপরই বাবা-মা আর টুনিকে দেখবে সে। বিয়ে করে এবার সংসারী হবে। খেতে-খামারে কাজ করে সংসার চালাবে, টুনির সঙ্গে সুখে দিন কাটাবে। মনের আকাশ জুড়ে সেই সুখের তারাগুলোই যেন জ্বলে ওঠে বারবার। হঠাৎ ঝড় শুরু হয়, ভয়ঙ্কর ঝড়। রেজা আঁকড়ে ধরে থাকে অন্য মানুষদের হাত। বাতাস এতটাই জোরে বইছিল যে নিয়ন্ত্রণ রাখা বড় দায়। ভয়ে কয়েকজন চিৎকার করতে থাকে। রেজা প্রচণ্ড ভয় পেয়ে যায়। হাতে থাকা ব্যাগটা ফসকে যায় সেটা ধরতে গিয়ে হঠাৎ পিছলে পড়ে যায় ট্রেনের ছাদ থেকে। কানে কেবল ভেসে আসে কিছু মানুষের চিৎকার আর ট্রেনের শব্দ। তারপর সব নিশ্চুপ।
৪.
রেজাদের বাড়ির পাশ দিয়েই ট্রেন যায় কিছুদূর গেলেই স্টেশন। রেজার মা ছেলের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে দরজার সামনে। বাবা একটু পর পর কাশি দিয়ে উঠে বলে, কই ছেলেটা এল?। টুনি কারণে-অকারণে ঘোরাফেরা করে রেজাদের বাড়ির আশপাশে কিন্তু রেজা আসে না। দিন ফুরিয়ে রাত হলো, আকাশে উঁকি দিলো ঈদের চাঁদ কিন্তু তার সোনামাণিক এখনো ফেরেনি ঘরে। রেজার মা তাকিয়ে থাকে পথের দিকে। কিন্তু রেজার মতো কেউ আসে না। অজানা ভয়ে তার চোখের কোণে জল চিকচিক করে। মনে প্রার্থনা করে সৃষ্টিকর্তার কাছে ছেলের যেন কিছু না হয়। কয়েকটা জোনাক পোকা কেবল পথের এপাশ থেকে ওপাশে ছোটাছুটি করে। ঠিক সেই মুহ‚র্তে একটা লাশবাহী অ্যাম্বুলেস এসে ঢুকে রেজাদের বাড়িতে।
No comments:
Post a Comment