join facebook page

Wednesday, 28 September 2016

সমকালে আজ প্রকাশিত ঈদ নিয়ে গল্প আপাতত লেখা এবং অলংকরণ দুটোই আমার হাতে সময় থাকলে পড়তে পারেন........

গল্পের ওপারের মেয়েটি

সোহানুর রহমান অনন্ত

স্টেশন থেকে আধা কিলোমিটার গেলেই চেয়ারম্যানবাড়ি। আমার মায়ের দুঃসম্পর্কের আত্মীয়বাড়ি সেটা। এর আগে কখনও আসা হয়নি। মাথায় হঠাৎ ভূত চাপল_ ঈদটা ঢাকার বাইরে করব। মাকে জানাতেই মন খারাপ করল। কারণ এতটুকু বয়সে আমি কখনও মাকে ছাড়া ঈদ করিনি। কিন্তু চিরকাল তো মানুষ একই নিয়মে চলতে পারে না। ঠিকানা দিয়ে বলল, ওখানে তোর কোনো অসুবিধা হবে না। দেড় ঘণ্টা লেটে ট্রেন স্টেশনে পেঁৗছেছে। একটা রিকশা নিয়ে কিছুদূর গেলাম তারপর হাঁটার পথ। দূরের কোথাও টিমটিম আলো জ্বলছে। একটা চায়ের দোকান দেখে জানতে চাইলাম, চেয়ারম্যানবাড়ি কোনদিকে? তিনি হাত উঁচু করে দেখিয়ে দিলেন। বাড়িটার কাছে যেতেই দেখি অল্প বয়সী এক মেয়ে হারিকেন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। হালকা আলোয় তার চেহারা তেমন বোঝা যাচ্ছে না। আমাকে দেখে এগিয়ে এসে বলল, আপনি ঢাকা থেকে এসেছেন? চমকে গেলাম আমি। গ্রামের মেয়েরা সাধারণরত আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলে।

প্রশ্নটা দ্বিতীয়বার করল আমাকে। হ্যাঁ। আমার পেছনে আসুন। আমি তাকে অনুসরণ করতে লাগলাম। অনেক পুরনো বাড়ি। কিছুদূর হেঁটে যাওয়ার পর একটা ঘরে ঢুকল। আমিও পেছনে ঢুকলাম। এক ভদ্রমহিলা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে বললেন, বসো বাবা। এদিক-ওদিক তাকিয়ে বসলাম। তিনি বললেন, তোমার কষ্ট হয়নি তো আসতে? হেসে বললাম, না ঠিক...। মেয়েটা পাশের রুম থেকে এসে আমাকে এক গ্গ্নাস লেবুর শরবত দিল। তখনও ভালো করে দেখা হয়নি মেয়েটিকে। কথার পর্ব শেষে খাওয়া-দাওয়া করে শুয়ে পড়লাম। জানালা দিয়ে অসংখ্য জোনাকির সাথে সেই মিষ্টি ফুলের গন্ধটা এসে ঘরে ঢুকছিল।

গ্রামের মানুষ খুব দ্রুত ঘুম থেকে উঠে যায়। আমার ঘুম ভাঙল মিষ্টি রিনিঝিনি চুড়ির শব্দে। চোখ মেলতেই দেখি, একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। রাতের মেয়েটি, এতক্ষণে ভালো করে দেখলাম। এক কথায় সুন্দরী বলতে যা বোঝায়। মেয়েটির বয়স কম ভেবে ভুল করেছি। আসলে মেয়েটি একটু শর্ট। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, মা ডাকছে। মেয়েটির প্রতিটি শব্দ কেন যেন আমার ইন্দ্রিয়ে শিহরণ তুলছিল! এক ফাঁকে মেয়েটির নাম জেনে গেলাম_ তৃষা। তারপর অসংখ্যবার চোখাচোখি। সারাদিন সবার সাথে কথা বললেও আমার কান একজনের হাসি আর পায়ের শব্দের দিকে জাগ্রত। কী অদ্ভুত সমস্যায় পড়েছি আমি! তৃষা যেন একটু একটু করে আমার চোখের ভাষা বুঝতে পেরেছিল। ধরি মাছ না ছুঁই পানির মতো দূর থেকে দেখে আমায়। এভাবে দিনের আলো নিভে যায় রাত আসে নেমে। আমার ঘরের পাশেই ছিল জানালা। আমি বালিশে হেলান দিয়ে একটা বই পড়ছিলাম। কেউ একজন জানালার ওপাশ থেকে বলল, শুনছেন? আর একটু হলে ভয়ে চিৎকার করে উঠতাম। তাকিয়ে দেখি তৃষা দাঁড়িয়ে। একটু হাতটা জানালার বাইরে দিন। আমি যেন ওর কথায় নিবেদিত। সাথে সাথে বাইরে হাত দিলে কয়েকটা গন্ধরাজ ফুল আমার হাতে দিয়ে চলে গেল। আমি কেবল শুনলাম ঝুমঝুম কাচের চুড়ির শব্দ।

এই বাড়িটার নামকরণ হয় মঞ্জু চেয়ারম্যানের নামে। তারপর কত সময় কেটে গেছে। এখন কেউ চেয়ারম্যান নয়, তবুও চেয়ারম্যানবাড়ি। এই কয়েক দিনে একটা জিনিস নিশ্চিত হলাম_ আমি তৃষার প্রেমে পড়ে গেছি। তৃষা যদিও আমাকে ওইভাবে সবুজ সংকেত দেয়নি, তবে দেবে_ এতে আশাবাদী। কিন্তু কথাটা মাকে বলব কীভাবে? ঠিক সেই মুহূর্তে তৃষার মা আমাকে ডাকলেন। ঘরে ঢুকতেই দেখি, কয়েকজন মুরুবি্ব বসে আছেন। তৃষার মা বললেন, উনারা তৃষাকে দেখতে এসেছে। কথাটা শুনে মুহূর্তেই থমকে গেলাম। নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম, বেশ তো। তা ছেলে আসেনি? এসেছে তো; ওই যে। একজন বয়স্ক লোককে দেখিয়ে বললেন তিনি। আমি পুরোপুরি হতবাক। লোকটার বয়স চলি্লশের কাছাকাছি। চুপচাপ শুনলাম। তৃষাকে সাজিয়ে নিয়ে আসা হলো। একবারের জন্যও তাকাইনি ওর দিকে। বিয়ের কথা পাকা_ ঈদের একদিন আগেই বিয়ে হবে। রাতে তৃষার মা আমাকে জানালেন, এর আগে তৃষার একটা বিয়ে হয়েছিল কিন্তু খোদা সইলেন না। সাপের কামড়ে মারা গেল ছয় মাসের মাথায়। তাই এই বয়স্ক লোকটার হাতেই মেয়েটাকে তুলে দিচ্ছি। অবাক হওয়ার কিছু নেই। গ্রামে এসব হয়। একটা জিনিস খেয়াল করলাম, ওরা দেখে যাওয়ার পর থেকে তৃষা আর আমার সামনে আসছে না। কোথাও শুনছি না কাচের চুড়ির ঝুমঝুম শব্দ।

আজ রাতেই তৃষার বিয়ে। এই কয়েক দিন তৃষা আমার সামনে একেবারেই কম এসেছে। কোনো কথা বলেনি, সারাক্ষণ মুখ গোমড়া করে রেখেছে। চুপচাপ আমি ঘরের এক কোণে বসে আছি। জানালার পাশে কেউ একজন এসে দাঁড়াল; তৃষা। আমাকে বলল, কিছু কথা আছে আপনার সাথে। একটু আসবেন? ওর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। কাঁদছে শ্রাবণের আকাশের মতো।

আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন? অপ্রস্তুত হয়ে যাই আমি।

কী হলো?

আমিও আপনাকে ভালোবাসি। ভালো থাকবেন। একটা গন্ধরাজ ফুল আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। অপদার্থের মতো দাঁড়িয়ে রইলাম। আটকাতে পারলাম না। রাত ১০টার শেষ ট্রেনে ঢাকায় চলে আসি। আর কখনও যাইনি ওখানে। শুকিয়ে যাওয়া সেই গন্ধরাজ ফুলটা আজও আছে আমার কাছে। এরপর ঈদ এসেছে কিন্তু তৃষা আর কখনও ফিরে আসেনি। ফিরবেও না কোনোদিন।

No comments:

Post a Comment