তনু : সোহানুর রহমান অনন্ত
ভোরের কাগজ : ১০/০৫/২০১৪
পর্দার ওপাশ থেকে তনু আমার দিকে আবারো তাকালো। তারপর এক টুকরো হাসি দিয়ে চলে গেলো। তনুর ছোট বোন লিজাকে প্রাইভেট পড়াচ্ছি বেশ কিছুদিন হলো। পাস করে বের হয়েছি, চাকরি বাকরি কিছুই জুটেনি তাই টিউশনি করে নিজের হাত খরচটা চালাচ্ছি। তনু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী। বেশ মেধাবী, দেখতে মন্দ নয়। বেশ রুচিশীল একটি মেয়ে, ঘরের সব কিছু পরিপাটি থাকে সব সময়। তনুর মা মারা যাওয়ার পর তনুর বাবার দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তনুর নতুন মা ব্যাংকে চাকরি করেন। বেশ গুছানো একটা সংসার। ঘর থেকে বের হওয়ার আগে আবারো নজর পড়লো তনুর ওপর। আড়াল থেকে দেখছে আমাকে। খুব নীরবে।
২.
ইদানীং দুবেলা আমি লিজাকে প্রাইভেট পড়াচ্ছি। তনুকে দেখার আশায়। তনুর হাতের এককাপ মিষ্টি চা খাওয়ার আশায়। তনুকে নিয়ে আমার স্বপ্ন দিন দিন বড় হতে থাকলো। আর এর মধ্যেই আমার চাকরি হয়ে যায়। সেদিন বিকেলে বুক স্টলে দাঁড়িয়ে একটা বই খুঁজছিলাম। পেছনে কে যেন এসে দাঁড়ালো। তাকিয়ে দেখি তনু। এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখলাম আপনি দাঁড়িয়ে আছেন। আপনি কি মাঝে মাঝেই এখানে আসেন? আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, বলতে পারেন। বই কেনার জন্য মাঝে মাঝেই আসা হয় এখানে। তা আপনি কোথা থেকে আসলেন? বান্ধবীর বাসায় গিয়েছিলাম। চলুন না কোথায় বসে কথা বলি। তনুর চোখেমুখে ভালোবাসার ছায়া।
হুঁ চলুন।
৩.
কফিতে চুমুক দিয়ে তনু বললো, একটা কথা বলি?
Ñবলুন।
Ñরাগ করবেন না তো?
Ñআমার রাগটা সীমিত তাই যখন তখন রাগ করিনি।
Ñআপনি কি বিবাহিত? তনু যে এমন প্রশ্ন করবে ভাবতেও পারিনি।
Ñআমাকে দেখে কি তাই মনে হয়?
Ñনা মানুষ দেখে তো তেমন কিছু বোঝা যায় না,
Ñবুঝতে হলে তার সম্পর্কে জানতে হয়। সবে জবে ঢুকলাম কয়েক বছর চাকরি করি তারপর দেখা যাবে।
Ñআচ্ছা আমাকে আপনার কেমন লাগে, তনু বলল।
Ñ আমি বললাম, হুঁ ভালো লাগে।
Ñতাই!। এমন সময় আমার ফোন এলো।
Ñ আচ্ছা আমাকে আজ উঠতে হচ্ছে, বিশেষ একটা কাজ আছে মালিবাগে। তনুর মুখটা বিষণœতায় ঢেকে গেলো। ঠিক বুঝতে পারছিলাম কিছু একটা বলতে চাইছে।
৪.
তনুর মুখ থেকে ভালোবাসার কথাটা শুনে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয়েছে। তারপর থেকে কেবলই ভালোবাসার আদান-প্রদান। তনুর সঙ্গে আমার ভালোবাসার দীর্ঘ সময় কেটে গেলো। ইদানীং আর তনুকে ভালো লাগে না আমার। কেমন যেন একটা অনীহা কাজ করছে। সুন্দরী কলিগ, বৃষ্টির প্রতি নিজের আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর তাই তনুর সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে।
তনুর সঙ্গে এখন আর তেমন দেখা করি না। ফোনেও কথা বলি না আমি। এমনো সময় গেছে কানে ফোন রেখে ঘুমিয়ে গেছি, তনুর মিষ্টির কথার ছন্দে। এখন আর এসব ভালো লাগে না। একদিন টিএসসিতে দুজন দেখা করলাম।
তনু জানালো, বাসা থেকে বিয়ের চাপ দেয়া হচ্ছে, তাই তনুকে বিয়ে করতে হবে। প্রথম দেখার তনুকে যেমন পাওয়ার জন্য সব করতে পারতাম, এখনকার তনুর জন্য যেন আমি কিছুই করতে পারি না। তাই তনুর মুখের ওপরই না করে ফেললাম। আমার কথা শুনে তনু আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। টলমল করতে লাগলো ওর চোখের জল। শুধু মুখ ফুটে বললো, ভালোবাসাকে কষ্ট দিতে নেই, ভালোবাসাকে কষ্ট দিয়ে কেউ সুখী হতে পারে না। কিন্তু তাতেও এক বিন্দু আমার মন গললো না। আমি ওর কথা শুনে আরো রেগে গেলাম। উত্তেজিত হয়ে বললামÑ আবেগ দিয়ে তো আর জীবন চলে না। তনু এক হাত দিয়ে চোখের জল মুছে বললো, ঠিক আছে তোমার সুখের পথ তুমি বেছে নাও। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে চলে আসলাম। আসার সময় পেছনে ফিরে একবার তাকালাম। তনু তখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
৫.
এরপর আর তনুর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। কেটে গেছে কয়েকটি বছর। কোনো খোঁজও নেইনি আমি। সেই সুন্দরী কলিগকে বিয়ে করে আমি এখন সংসারি। একটা ছেলে হয়েছে আমার। ফুটফুটে, রাজপুত্র। তবুও যেন আমি সুখী নেই। কেন সুখী নেই তার উত্তরও খুঁজতে যাই না। অতীত টানতে চাই না আমি তাই তনুকে ভুলে গেছি প্রায়, এমন সময় একদিন লিজার সঙ্গে নিউমার্কেট দেখা হয়ে গেলো। কথায় কথায় তনুর কথা জিজ্ঞেস করতেই, লিজা জানালো। আপা এখন মানসিক রোগী। মানে? মানে আপনার সঙ্গে যেদিন ব্রেকআপ হয়েছে, সেদিনের পর থেকে আপার আচরণ বদলে যায়। কোনো কিছু সহ্য করতে পারে না। দিন দিন আপার অবস্থা খারাপ হতে থাকে।
কতো ডাক্তার দেখানো হয়েছে কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। সারাক্ষণ ঘরে আটকিয়ে রাখতে হয় আপাকে। এই বলে কেঁদে দিলো লিজা। কথাটা শুনে কষ্টে মনটা ভরে উঠলো। মেয়েটিকে এভাবে কষ্ট না দিলেও পারতাম। লিজার সঙ্গে তনুকে দেখতে গেলাম। জানালার শিক ধরে তনু দাঁড়িয়ে ছিল।
চোখ দুটো ফুলে আছে, দেখেই বুঝা যাচ্ছিল অনেক কেঁদেছে। মাথার চুলগুলো এলোমেলো। সেই মায়াভরা সুন্দর মুখে কালচে রঙ। আমি কাছে গিয়ে বললামÑ তনু আমাকে চিনতে পেরেছো? প্লিজ ক্ষমা করো আমাকে। তনু আমার কথা কিছুই বুঝলো বলে মনে হলো না, শুধু ড্যাব ড্যাব করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। যার ভালোবাসায় জীবনের একটা অধ্যায় আমার কেটে গেছে। আজ সে কিনা আমারই জন্য একলা জগতের বাসিন্দা।
বন্দী ঘরে বন্দী আমার ভালোবাসা, যার জন্য কেবল আমি দায়ী। আমি হাত বাড়িয়ে তনুর হাতটা ধরতে যাবো এমন সময় তনু জানালাটা বন্ধ করে দিলো। আমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলাম। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য ব্যক্তি মনে হচ্ছিল। ভেতর থেকে তনুর শিশুসুলভ কথা কানে আসছিল। আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা। তনুর প্রতিটি কথাই যেন আমাকের বুকে আঘাত করছিল। ভালোবাসাকে কষ্ট দিতে নেই, ভালোবাসাকে কষ্ট দিয়ে কেউ সুখী হতে পারে না, তনুর কথাটা আবার মনে পড়ে গেলো।
ভোরের কাগজ : ১০/০৫/২০১৪
পর্দার ওপাশ থেকে তনু আমার দিকে আবারো তাকালো। তারপর এক টুকরো হাসি দিয়ে চলে গেলো। তনুর ছোট বোন লিজাকে প্রাইভেট পড়াচ্ছি বেশ কিছুদিন হলো। পাস করে বের হয়েছি, চাকরি বাকরি কিছুই জুটেনি তাই টিউশনি করে নিজের হাত খরচটা চালাচ্ছি। তনু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি বিভাগের ছাত্রী। বেশ মেধাবী, দেখতে মন্দ নয়। বেশ রুচিশীল একটি মেয়ে, ঘরের সব কিছু পরিপাটি থাকে সব সময়। তনুর মা মারা যাওয়ার পর তনুর বাবার দ্বিতীয় বিয়ে করেন। তনুর নতুন মা ব্যাংকে চাকরি করেন। বেশ গুছানো একটা সংসার। ঘর থেকে বের হওয়ার আগে আবারো নজর পড়লো তনুর ওপর। আড়াল থেকে দেখছে আমাকে। খুব নীরবে।
২.
ইদানীং দুবেলা আমি লিজাকে প্রাইভেট পড়াচ্ছি। তনুকে দেখার আশায়। তনুর হাতের এককাপ মিষ্টি চা খাওয়ার আশায়। তনুকে নিয়ে আমার স্বপ্ন দিন দিন বড় হতে থাকলো। আর এর মধ্যেই আমার চাকরি হয়ে যায়। সেদিন বিকেলে বুক স্টলে দাঁড়িয়ে একটা বই খুঁজছিলাম। পেছনে কে যেন এসে দাঁড়ালো। তাকিয়ে দেখি তনু। এই পথ দিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ দেখলাম আপনি দাঁড়িয়ে আছেন। আপনি কি মাঝে মাঝেই এখানে আসেন? আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম, বলতে পারেন। বই কেনার জন্য মাঝে মাঝেই আসা হয় এখানে। তা আপনি কোথা থেকে আসলেন? বান্ধবীর বাসায় গিয়েছিলাম। চলুন না কোথায় বসে কথা বলি। তনুর চোখেমুখে ভালোবাসার ছায়া।
হুঁ চলুন।
৩.
কফিতে চুমুক দিয়ে তনু বললো, একটা কথা বলি?
Ñবলুন।
Ñরাগ করবেন না তো?
Ñআমার রাগটা সীমিত তাই যখন তখন রাগ করিনি।
Ñআপনি কি বিবাহিত? তনু যে এমন প্রশ্ন করবে ভাবতেও পারিনি।
Ñআমাকে দেখে কি তাই মনে হয়?
Ñনা মানুষ দেখে তো তেমন কিছু বোঝা যায় না,
Ñবুঝতে হলে তার সম্পর্কে জানতে হয়। সবে জবে ঢুকলাম কয়েক বছর চাকরি করি তারপর দেখা যাবে।
Ñআচ্ছা আমাকে আপনার কেমন লাগে, তনু বলল।
Ñ আমি বললাম, হুঁ ভালো লাগে।
Ñতাই!। এমন সময় আমার ফোন এলো।
Ñ আচ্ছা আমাকে আজ উঠতে হচ্ছে, বিশেষ একটা কাজ আছে মালিবাগে। তনুর মুখটা বিষণœতায় ঢেকে গেলো। ঠিক বুঝতে পারছিলাম কিছু একটা বলতে চাইছে।
৪.
তনুর মুখ থেকে ভালোবাসার কথাটা শুনে নিজেকে খুব ভাগ্যবান মনে হয়েছে। তারপর থেকে কেবলই ভালোবাসার আদান-প্রদান। তনুর সঙ্গে আমার ভালোবাসার দীর্ঘ সময় কেটে গেলো। ইদানীং আর তনুকে ভালো লাগে না আমার। কেমন যেন একটা অনীহা কাজ করছে। সুন্দরী কলিগ, বৃষ্টির প্রতি নিজের আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর তাই তনুর সঙ্গে একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গেছে।
তনুর সঙ্গে এখন আর তেমন দেখা করি না। ফোনেও কথা বলি না আমি। এমনো সময় গেছে কানে ফোন রেখে ঘুমিয়ে গেছি, তনুর মিষ্টির কথার ছন্দে। এখন আর এসব ভালো লাগে না। একদিন টিএসসিতে দুজন দেখা করলাম।
তনু জানালো, বাসা থেকে বিয়ের চাপ দেয়া হচ্ছে, তাই তনুকে বিয়ে করতে হবে। প্রথম দেখার তনুকে যেমন পাওয়ার জন্য সব করতে পারতাম, এখনকার তনুর জন্য যেন আমি কিছুই করতে পারি না। তাই তনুর মুখের ওপরই না করে ফেললাম। আমার কথা শুনে তনু আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। টলমল করতে লাগলো ওর চোখের জল। শুধু মুখ ফুটে বললো, ভালোবাসাকে কষ্ট দিতে নেই, ভালোবাসাকে কষ্ট দিয়ে কেউ সুখী হতে পারে না। কিন্তু তাতেও এক বিন্দু আমার মন গললো না। আমি ওর কথা শুনে আরো রেগে গেলাম। উত্তেজিত হয়ে বললামÑ আবেগ দিয়ে তো আর জীবন চলে না। তনু এক হাত দিয়ে চোখের জল মুছে বললো, ঠিক আছে তোমার সুখের পথ তুমি বেছে নাও। আমাকে নিয়ে ভাবতে হবে না। আর কোনো কথা না বাড়িয়ে সেখান থেকে চলে আসলাম। আসার সময় পেছনে ফিরে একবার তাকালাম। তনু তখনো আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
৫.
এরপর আর তনুর সঙ্গে আমার দেখা হয়নি। কেটে গেছে কয়েকটি বছর। কোনো খোঁজও নেইনি আমি। সেই সুন্দরী কলিগকে বিয়ে করে আমি এখন সংসারি। একটা ছেলে হয়েছে আমার। ফুটফুটে, রাজপুত্র। তবুও যেন আমি সুখী নেই। কেন সুখী নেই তার উত্তরও খুঁজতে যাই না। অতীত টানতে চাই না আমি তাই তনুকে ভুলে গেছি প্রায়, এমন সময় একদিন লিজার সঙ্গে নিউমার্কেট দেখা হয়ে গেলো। কথায় কথায় তনুর কথা জিজ্ঞেস করতেই, লিজা জানালো। আপা এখন মানসিক রোগী। মানে? মানে আপনার সঙ্গে যেদিন ব্রেকআপ হয়েছে, সেদিনের পর থেকে আপার আচরণ বদলে যায়। কোনো কিছু সহ্য করতে পারে না। দিন দিন আপার অবস্থা খারাপ হতে থাকে।
কতো ডাক্তার দেখানো হয়েছে কিন্তু কিছুতেই কিছু হয়নি। সারাক্ষণ ঘরে আটকিয়ে রাখতে হয় আপাকে। এই বলে কেঁদে দিলো লিজা। কথাটা শুনে কষ্টে মনটা ভরে উঠলো। মেয়েটিকে এভাবে কষ্ট না দিলেও পারতাম। লিজার সঙ্গে তনুকে দেখতে গেলাম। জানালার শিক ধরে তনু দাঁড়িয়ে ছিল।
চোখ দুটো ফুলে আছে, দেখেই বুঝা যাচ্ছিল অনেক কেঁদেছে। মাথার চুলগুলো এলোমেলো। সেই মায়াভরা সুন্দর মুখে কালচে রঙ। আমি কাছে গিয়ে বললামÑ তনু আমাকে চিনতে পেরেছো? প্লিজ ক্ষমা করো আমাকে। তনু আমার কথা কিছুই বুঝলো বলে মনে হলো না, শুধু ড্যাব ড্যাব করে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো। যার ভালোবাসায় জীবনের একটা অধ্যায় আমার কেটে গেছে। আজ সে কিনা আমারই জন্য একলা জগতের বাসিন্দা।
বন্দী ঘরে বন্দী আমার ভালোবাসা, যার জন্য কেবল আমি দায়ী। আমি হাত বাড়িয়ে তনুর হাতটা ধরতে যাবো এমন সময় তনু জানালাটা বন্ধ করে দিলো। আমি জানালার পাশে দাঁড়িয়ে কাঁদতে লাগলাম। নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে জঘন্য ব্যক্তি মনে হচ্ছিল। ভেতর থেকে তনুর শিশুসুলভ কথা কানে আসছিল। আয় আয় চাঁদ মামা টিপ দিয়ে যা। তনুর প্রতিটি কথাই যেন আমাকের বুকে আঘাত করছিল। ভালোবাসাকে কষ্ট দিতে নেই, ভালোবাসাকে কষ্ট দিয়ে কেউ সুখী হতে পারে না, তনুর কথাটা আবার মনে পড়ে গেলো।
No comments:
Post a Comment