০৮-১২-২০১৫ দৈনিক সমকালের সুহৃদ-এ
বাবা আর ফেরেনি
সোহানুর রহমান অনন্ত
ফিসফিস কথার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখি, মা কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। আমি তখন বারো বছরের বালক। আকাশে ফুটফুটে চাঁদ, তার আলো ছড়িয়ে পড়েছে সব জায়গায়। চাদর মুড়ি দেওয়া একজন লোক দাঁড়িয়ে জানালার ওপাশে। আমি উঠে গেছি বুঝতে পেরে মা মুখে আঙুল দিয়ে শব্দ না করার জন্য বলল। বুঝতে পারলাম, ওপাশের মানুষটি আর কেউ নয়, আমার বাবা। মুহূর্তে সব ঘুম কোথায় যে হারিয়ে গেল বুঝতে পারিনি। ছুটে গেলাম মায়ের কাছে, ফিসফিস করে বললাম, বাবা। বাবা জানালা দিয়ে আমার গালে হাত রাখলেন, বাবা কাঁদছিলেন। বাবা এবার আমিও তোমার সঙ্গে যাব। আমার কথা শুনে বাবা বললেন, অবশ্যই বাবা আবার যখন আসব তোমাকে নিয়ে যাব। আমি রাগ হয়ে বললাম, আগেরবারও একই কথা বলেছ তুমি। বাবা কিছুই বললেন না। মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমি তাকিয়ে ছিলাম বাবার চলে যাওয়ার দিকে। এক সময় বরই গাছটার ছায়ার আড়ালে বাবা হারিয়ে গেলেন। বাবার জন্য খুব খারাপ লাগছিল, মা কাঁদছিলেন নীরবে। কাছে কোথাও হু হু করে একটা হুতুম পেঁচা ডেকে উঠল।
২.
গ্রামের মানুষ ভয়ে পালাতে শুরু করেছে। যে কোনো সময় পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামে হামলা করতে পারে। লোকমুখে শোনা যায়, আট মাইল দূরে লক্ষ্মীগ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী সাধারণ গ্রামবাসীকে হত্যা করে পুরো গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমি সারাক্ষণ জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকি। গ্রামটা থমথমে, কেউ খেলতেও আসে না সোনাদের মাঠে। শূন্য মাঠ, পথঘাট। বাজারে দোকানপাটও বন্ধ। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু অশিত কয়েক দিন আগে বাবা-মায়ের সঙ্গে বর্ডার পার হয়ে কলকাতা চলে গেছে। বলেছে, যুদ্ধ থামলে আসবে। মায়ের বারণ থাকায় বাইরে যেতে পারছিলাম না। বন্দি পাখির মতো সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকতাম। এরই মধ্যে গ্রামে একদিন পাকিস্তানি বাহিনী সত্যি ঢুকে পড়ল। বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে মানুষ হত্যা করতে লাগল। বাঁচাও বাঁচাও বলে মানুষ যে যার মতো পালাতে লাগল। আমার হাত ধরে মাও নদীর দিকে ছুটে গিয়েছিল। বাঁচার চেষ্টা সবার মাঝে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, এই তো পেছন থেকে পাকিস্তানি বাহিনী এসে গুলি করে দেবে। নদীর পারে ধু-ধু বালু প্রান্তর। কাশঘেরা একটা জায়গায় আমরা লুকিয়ে পড়লাম। গ্রামের মধ্যে আগুন জ্বলছে, সঙ্গে আর্তনাদ। বাবার কথা তখন সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছিল। জানি না বাবা কোথায়?।
৩.
সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নরম আলো এসে চোখের কোণে আঘাত করল। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই। পাশে মা জেগে আছেন। আমি মাকে বললাম, মা আমরা কোথায় যাব। মা বললেন, জানি না রে। তারপর নদীর পাড় ছুটে চললাম, তিন গ্রাম দূরে আমার নানাবাড়ি। সেখানে যেতেই দেখি তারা অনেক আগেই পালিয়ে গেছে। শূন্য বাড়ি, উঠান। পুরো গ্রাম শূন্য। ঠিক সে মুহূর্তে কী করা প্রয়োজন, মাথায় আসছিল না। মায়ের সঙ্গে হাঁটতে লাগলাম। কোথায় যাচ্ছি জানি না। কে জানি হয়তো যে মিলিটারির ভয়ে ছুটে চলছি তাদের সামনে গিয়েই পড়ব। যেমন কথায় আছে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়। মা এক সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন, এমনিতেই মায়ের হাঁপানির সমস্যা ছিল। হাঁটতে পারছিলেন না। রাস্তার পাশে মা বসে পড়লেন। না খেয়ে মায়ের পাশেই পড়ে রইলাম। দিন কেটে রাত, আবার রাত কেটে দিন। কোথাও মানুষের দেখা নেই। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। মরলে এখানেই পড়ে মরব। এভাবেই মা আর আমার দিন কাটতে লাগল। রাতের খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে মা'কে বললাম, বাবার সঙ্গে আর দেখা হবে না?। মা কাঁদতেন, কোনো উত্তর দিতে পারতেন না। জানি না বাবা কোথায় আছে, ভালো আছে কি-না।
৪.
অবশেষে অনেক রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা এলো। নতুন এক ভোর এলো আমাদের জীবনে। মা ততদিনে অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মানুষ ফিরতে শুরু করেছে তাদের ঘরবাড়িতে। গ্রামে ফিরে দেখি আমাদের ঘরটা আগের মতোই আছে। গ্রামে ফেরার তিন দিনের মাথায় মা মারা গেলেন। আমি সম্পূর্ণ একা হয়ে গেলাম। বাবার অপেক্ষায় আমার প্রতিটি সময় কাটতে লাগল। যুদ্ধ থেকে ফিরে আসা অনেককেই জিজ্ঞেস করেছি বাবাকে দেখেছে কি-না?। তারা দেখেনি বলে চলে যেত। অনেকেই ফিরে এলো, বাবা আর আসেনি। এখনও আমি বাবার অপেক্ষায় দিন পার করি, জানি না আমার বাবা কোথায় আছেন। তবুও বাবার জন্য অপেক্ষা করি, শুধু একটা কথা বলতে, বাবা তোমাকে অনেক ভালোবাসি।
হ সুহৃদ ঢাকা
বাবা আর ফেরেনি
সোহানুর রহমান অনন্ত
ফিসফিস কথার শব্দে ঘুম ভেঙে গেল। তাকিয়ে দেখি, মা কার সঙ্গে যেন কথা বলছে। আমি তখন বারো বছরের বালক। আকাশে ফুটফুটে চাঁদ, তার আলো ছড়িয়ে পড়েছে সব জায়গায়। চাদর মুড়ি দেওয়া একজন লোক দাঁড়িয়ে জানালার ওপাশে। আমি উঠে গেছি বুঝতে পেরে মা মুখে আঙুল দিয়ে শব্দ না করার জন্য বলল। বুঝতে পারলাম, ওপাশের মানুষটি আর কেউ নয়, আমার বাবা। মুহূর্তে সব ঘুম কোথায় যে হারিয়ে গেল বুঝতে পারিনি। ছুটে গেলাম মায়ের কাছে, ফিসফিস করে বললাম, বাবা। বাবা জানালা দিয়ে আমার গালে হাত রাখলেন, বাবা কাঁদছিলেন। বাবা এবার আমিও তোমার সঙ্গে যাব। আমার কথা শুনে বাবা বললেন, অবশ্যই বাবা আবার যখন আসব তোমাকে নিয়ে যাব। আমি রাগ হয়ে বললাম, আগেরবারও একই কথা বলেছ তুমি। বাবা কিছুই বললেন না। মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। আমি তাকিয়ে ছিলাম বাবার চলে যাওয়ার দিকে। এক সময় বরই গাছটার ছায়ার আড়ালে বাবা হারিয়ে গেলেন। বাবার জন্য খুব খারাপ লাগছিল, মা কাঁদছিলেন নীরবে। কাছে কোথাও হু হু করে একটা হুতুম পেঁচা ডেকে উঠল।
২.
গ্রামের মানুষ ভয়ে পালাতে শুরু করেছে। যে কোনো সময় পাকিস্তানি বাহিনী গ্রামে হামলা করতে পারে। লোকমুখে শোনা যায়, আট মাইল দূরে লক্ষ্মীগ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী সাধারণ গ্রামবাসীকে হত্যা করে পুরো গ্রামে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমি সারাক্ষণ জানালা দিয়ে তাকিয়ে থাকি। গ্রামটা থমথমে, কেউ খেলতেও আসে না সোনাদের মাঠে। শূন্য মাঠ, পথঘাট। বাজারে দোকানপাটও বন্ধ। আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু অশিত কয়েক দিন আগে বাবা-মায়ের সঙ্গে বর্ডার পার হয়ে কলকাতা চলে গেছে। বলেছে, যুদ্ধ থামলে আসবে। মায়ের বারণ থাকায় বাইরে যেতে পারছিলাম না। বন্দি পাখির মতো সারাক্ষণ ঘরে বসে থাকতাম। এরই মধ্যে গ্রামে একদিন পাকিস্তানি বাহিনী সত্যি ঢুকে পড়ল। বাড়িতে বাড়িতে ঢুকে মানুষ হত্যা করতে লাগল। বাঁচাও বাঁচাও বলে মানুষ যে যার মতো পালাতে লাগল। আমার হাত ধরে মাও নদীর দিকে ছুটে গিয়েছিল। বাঁচার চেষ্টা সবার মাঝে। মাঝে মাঝে মনে হচ্ছিল, এই তো পেছন থেকে পাকিস্তানি বাহিনী এসে গুলি করে দেবে। নদীর পারে ধু-ধু বালু প্রান্তর। কাশঘেরা একটা জায়গায় আমরা লুকিয়ে পড়লাম। গ্রামের মধ্যে আগুন জ্বলছে, সঙ্গে আর্তনাদ। বাবার কথা তখন সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছিল। জানি না বাবা কোথায়?।
৩.
সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে নরম আলো এসে চোখের কোণে আঘাত করল। কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই। পাশে মা জেগে আছেন। আমি মাকে বললাম, মা আমরা কোথায় যাব। মা বললেন, জানি না রে। তারপর নদীর পাড় ছুটে চললাম, তিন গ্রাম দূরে আমার নানাবাড়ি। সেখানে যেতেই দেখি তারা অনেক আগেই পালিয়ে গেছে। শূন্য বাড়ি, উঠান। পুরো গ্রাম শূন্য। ঠিক সে মুহূর্তে কী করা প্রয়োজন, মাথায় আসছিল না। মায়ের সঙ্গে হাঁটতে লাগলাম। কোথায় যাচ্ছি জানি না। কে জানি হয়তো যে মিলিটারির ভয়ে ছুটে চলছি তাদের সামনে গিয়েই পড়ব। যেমন কথায় আছে, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই রাত হয়। মা এক সময় অসুস্থ হয়ে পড়লেন, এমনিতেই মায়ের হাঁপানির সমস্যা ছিল। হাঁটতে পারছিলেন না। রাস্তার পাশে মা বসে পড়লেন। না খেয়ে মায়ের পাশেই পড়ে রইলাম। দিন কেটে রাত, আবার রাত কেটে দিন। কোথাও মানুষের দেখা নেই। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই। মরলে এখানেই পড়ে মরব। এভাবেই মা আর আমার দিন কাটতে লাগল। রাতের খোলা আকাশের দিকে তাকিয়ে মা'কে বললাম, বাবার সঙ্গে আর দেখা হবে না?। মা কাঁদতেন, কোনো উত্তর দিতে পারতেন না। জানি না বাবা কোথায় আছে, ভালো আছে কি-না।
৪.
অবশেষে অনেক রক্তের বিনিময়ে স্বাধীনতা এলো। নতুন এক ভোর এলো আমাদের জীবনে। মা ততদিনে অনেক অসুস্থ হয়ে পড়েছে। মানুষ ফিরতে শুরু করেছে তাদের ঘরবাড়িতে। গ্রামে ফিরে দেখি আমাদের ঘরটা আগের মতোই আছে। গ্রামে ফেরার তিন দিনের মাথায় মা মারা গেলেন। আমি সম্পূর্ণ একা হয়ে গেলাম। বাবার অপেক্ষায় আমার প্রতিটি সময় কাটতে লাগল। যুদ্ধ থেকে ফিরে আসা অনেককেই জিজ্ঞেস করেছি বাবাকে দেখেছে কি-না?। তারা দেখেনি বলে চলে যেত। অনেকেই ফিরে এলো, বাবা আর আসেনি। এখনও আমি বাবার অপেক্ষায় দিন পার করি, জানি না আমার বাবা কোথায় আছেন। তবুও বাবার জন্য অপেক্ষা করি, শুধু একটা কথা বলতে, বাবা তোমাকে অনেক ভালোবাসি।
হ সুহৃদ ঢাকা
No comments:
Post a Comment