join facebook page

Monday, 14 July 2014


daily chadpur kantha shishu kantha চাঁদপুর, বৃহস্পতিবার, ১০ জুলাই ২০১৪, ২৬ আষাঢ় ১৪২১
নিয়ম ছায়াবৃত্ত
সোহানুর রহমান অনন্ত
১. সকালে বৃষ্টি হয়েছে, এখনো আকাশটা মেঘে ঢাকা। রাকিবের বারান্দায় দাঁড়ালে আকাশ দেখা যায়। যদিও দিন দিন শহরের অট্টালিকার আড়ালে সুন্দর আকাশটা হারিয়ে যাচ্ছে। রাকিব বাসায় একাই থাকে। বাবা ব্যবসায় ব্যস্ত আর মা ব্যাংক জব নিয়ে। একা থাকাটা কষ্ট হলেও রাকিব সেটা মানিয়ে নিয়েছে। শহরের চার দেয়ালের আড়ালে অনেক কিছু ঢাকা থেকে যায়। কেউ জানে না কেউ জানতে চায়ও না। সঙ্গী বলতে কমল, তবে কমল কোনো মানুষ নয়, একটি ময়না পাখি। রাকিব শখ করে নাম দিয়েছে কমল। অনেকক্ষণ ধরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে রাকিব। আজ কেন যেন মনটা খুব খারাপ। আগে রোজ সকালে বাবা অফিস যাওয়ার আগে কপালে চুমু খেয়ে যেতো। ইদানীং সেটাও যেন বাবা ভুলে গেছে। মা দিনে চার পাঁচ বার ফোন করতো। সেটাও এখন কমে একে নেমে গেছে। স্কুল খোলা থাকলে সময় কেটে যায়, কিন্তু এখন স্কুল বন্ধ তাই সময়টা যেন বড্ড অলস হয়ে গেছে। রাকিবের চোখ পড়ে রাস্তায় হালকা জমে থাকা পানিতে কয়েকটি ছেলে ফুটবল খেলছে। বলের পেছনে ছোটাছুটি, হাসি, আনন্দ সবই চোখে পড়ে রাকিবের। মায়ের কড়া নিষেধ আছে বৃষ্টিতে ভেজা চলবে না। কড়া রোদে যাওয়া চলবে না। রাকিব বোঝাতে পারে না। রোদ, বৃষ্টি এগুলো প্রকৃতির নিয়ম। জীবনটাকে এত লুকিয়ে রাখলে চলে না। সব কিছুর সাথে মানিয়ে নিতে হয়। গোল, গোল শব্দে নিজেকে ফিরে পায় রাকিব। চারতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে নিজেকে আনন্দিত মনে হয়।

কম্পিউটারে অনেক ফুটবল খেলেছে রাকিব কিন্তু বাস্তবে খেলা হয়নি আজও। মা বলে খেলতে গেলে নাকি পা ভেঙে যাবে। তাই আর ছুঁয়ে দেখা হয়নি, উপভোগ করা হয়নি এই খেলাটাকে। ফোনটা বেজে উঠলো। খেলাটায় মন বসে গিয়েছিলো রাকিবের, ইচ্ছে হচ্ছিলো না ফোনটা ধরতে। কিন্তু ফোনটা বেজেই চলছে। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মায়ের কণ্ঠ : কী করছো সোনা?-কিছু না মা, তুমি কখন আসবে?-একটু দেরি হবে বাবা, তুমি খেয়ে একটা ঘুম দাও, চাঙ্গা লাগবে।-মা তোমাকে একটা কথা বলি?-এখন তোমার কথা শোনার সময় নেই বাবা, রাখছি। এই বলে মা ফোনটা রেখে দিলো।

রাকিবের মুখটা আবার কালো হয়ে গেলো। কী অদ্ভূত নিয়ম, সন্তানের কথা শোনার সময় নেই মায়ের। 'মাকে কিভাবে বুঝাই কমলের মতো এই চার দেয়ালে বন্দী থেকে আমিও নিসপ্রাণ হয়ে গেছি। বাইরের জগতটাকে আমি দেখতে চাই। কবি নজরুল ইসলামের মতো বলতে চাই, থাকবো নাকো বদ্ধ ঘরে দেখবো এবার জগৎটাকে। মোটা মোটা কিছু বই পড়লেই তো আর জগৎ চেনা যায় না!'

২. পড়ার টেবিলেই ঘুমিয়ে পড়েছিল রাকিব। মায়ের হাতের স্পর্শে ঘুম ভাঙে। ঘড়িতে তখন রাত একটা বেজে দশ।-মা তুমি কি এখন এলে?। হ্যাঁ বাবা, তুমি কিছু খেয়েছো? একা একা খেতে ভালো লাগে না মা, বাবা কোথায়?-তোমার বাবা একটা পার্টি-তে আছে, ফিরতে দেরি হবে।-মা একটা কথা বলি?-বলো।-চলো আমরা গ্রামে যাই।-কী সব চাষাদের মতো কথা বলছো? এই সব বুদ্ধি তোমাকে দিয়েছে কে? মনোযোগ দিয়ে পড়াশোনা করো, সামনে পরীক্ষা। এই বলে মা রুম থেকে চলে যায়। রাকিব একা বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ায়। কমলটা লাফালাফি করছে। রাতের অন্ধকারে ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। হাত বাড়িয়ে ছুঁয়ে দেখে রাকিব।

৩. কমলটা কেমন যেন অসুস্থ হয়ে পড়ছে দিন দিন। রাকিব কমলের সাথে কথা বলে। কী করবে কথা বলার লোকই যেহেতু নেই। বড়রা কেন শিশুদের মন বুঝতে চায় না। শিশুদেরও যে একটা জগৎ আছে। নিয়মের শেকলে সব কিছু বেঁধে দিলে তো জীবনই থেমে যাবে। আজও বাইরে বৃষ্টি, কত সুন্দর বৃষ্টি! ছেলেগুলো আজও ফুটবল খেলায় মেতে উঠেছে। ওদের পৃথিবী রঙিন, এটাই তো শৈশব, এটাই মনের শান্তির লক্ষ্যে ছুটে যাওয়া। রাকিবের চিন্তা করা ছাড়া আর কোনো কাজ নাই। আমার পৃথিবীটা একটা ফেইক। নকল মানুষের ফুটবল গেইম খেলে মনে শান্তি আনার চেষ্টা করি। মাথাটা ঝিমঝিম করে রাকিবের। কেন যেন খুব ইচ্ছে হয় কমলকে ছেড়ে দিতে। হোক না পাখি, ওর ও বনে যাওয়ার ইচ্ছে আছে, আছে মুক্ত আকাশে ডানা মেলে ওড়ার।

৪. শূন্য খাঁচাটার দিকে তাকিয়ে রাকিবের মা চীৎকার করে উঠে, রাকিব, এই রাকিব, কমলের খাঁচাটা খুললো কে? রাকিবের কোনো সাড়া শব্দ নেই। রাকিবের মা আজ খুব তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরেছে। রাকিবকে ঘরের কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। কান্না চলে আসে রাকিবের মায়ের। বারবার ফোন করে রাকিবের বাবাকে।-রাকিব, এই রাকিব কোথায় গেলি। অবশেষে ছাদে পাওয়া যায় রাকিবকে। এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে।-কী করছিস এখানে? আমি তোকে সব জায়গায় খুঁজেছি। -সারাক্ষণ ঘরে ভালো লাগে না মা। আমারও খুব ইচ্ছে হয় বাইরের পৃথিবীটা দেখতে, জানতে। বৃষ্টির জলে গা ভিজিয়ে ফুটবল খেলতে।-তুমি তো অসুস্থ হয়ে পড়বে বাবা। ওরা তো অসুস্থ হয় না মা। এই সব তোমাদের নিয়ম করা। কোন বইয়ের মাঝে তো এমন নিয়ম লেখা নেই মা। কোন কবিও এমন বন্দী থাকার কথা বলে যায়নি। বরং প্রতিটি বাংলা কবিতা-গল্পের মাঝে বলে গেছে প্রকৃতিকে চেনো, প্রকৃতির সাথে মেশো, তা হলেই প্রকৃত জীবনের স্বাদ উপভোগ করতে পারবে। প্রকৃতির কোনো নিয়ম নেই মা। কমলকে আমি ছেড়ে দিয়েছি। সারাক্ষণ বন্দী থেকে কমলও হাঁফিয়ে উঠেছে। বনের পাখি মুক্ত হয়ে বনেই ফিরে যাক। সরি মা, তোমাকে না জানিয়েই আমাকে এই কাজটা করতে হলো।

৫. ছেলের কথা শুনে নিজের শৈশবের কথা মনে পড়ে যায়। মাথায় বেণী দুলিয়ে গ্রামের পথ ধরে ছুটে চলা, বৃষ্টিতে কদম বনে হারিয়ে যাওয়া। কী সুন্দর শৈশব! অথচ আজ নিজেদের ইচ্ছে মত সন্তানদের খেলার পুতুল বানিয়ে রেখেছি। নিজের কাছেই খারাপ লাগছে। রাকিবের মাথায় হাত রেখে বলে- বড্ড ভুল হয়ে গেছেরে বাবা। আসলেই তো বন্দী জীবনে হতাশা ছাড়া আর কিছুই নেই। তুই আমার চোখের পর্দা সরিয়ে দিয়েছিস। আজ থেকে তোকে আর বারণ করবো না। রাকিবের মুখে হাসি ফুটে উঠে।-সত্যি বলছো?।-হ্যাঁ বাবা সত্যি।-চল না গ্রামে যাই।-যাবো, এই সপ্তাহে গ্রামে ঘুরতে যাবো কেমন।

রাকিবের আনন্দ আর ধরে না। কমলকে খুব মিস করবো, তবুও কমল এখন ভাল থাকবে এটাই কাম্য। সন্ধ্যার ক্লান্ত পাখিরা ফিরে যায় নীড়ে। রাকিব আর ওর মা ছাদে দাঁড়িয়ে দেখে। অনেকদিন পর রাকিবের মনে হয় দম ভরে বাতাস নিতে পাচ্ছে। হাত বাড়ালেই যেন আকাশের মেঘগুলোকে ছুঁতে পারবে। অনেক দিন পর...।

e-mail: sranontojugantor@gmail.com

No comments:

Post a Comment