join facebook page

Sunday, 13 July 2014

১০ জুলাই ২০১৪, বৃহস্পতিবার, ৯:৪৮

প্রতিশোধ
এস আর অনন্ত

সন্ধ্যা থেকে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। প্রতিদিনের ব্যস্ততম স্টেশনটি আজ একেবার শূন্য। কেবল একটি মেয়ে ব্যাগ হাতে বেঞ্চে বসে আছে, আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। আমি দূর থেকে দেখছিলাম। যদিও কোনো ভাবনা এখনো মনে ডালপালা মেলেনি। ও আমার পরিচয়ই তো দেয়া হয়নি। আমি শাফী মাহমুদ।
ব্যাচেলর মানুষ, স্টেশনের পাশে ছোট একটা চা-পানের দোকান। ছোট হলেও ব্যবসায় তো! নিজেকে ব্যবসায়ী ভাবা দোষের কিছু নয়।
অন্ধকারের বুক চিরে দানবীয় ট্রেনটি এসে থামল স্টেশনে। আমি ভাবলাম, হয়তো মেয়েটি ট্রেনে উঠে যাবে। কিন্তু না, দু-চারেক লোক ট্রেন থেকে নামল, তারপর এদিকে-ওদিক করে স্টেশন থেকে হারিয়ে গেল। ট্রেনটাও গর্জন করে আবার চলতে লাগল। এবার আমি রীতিমতো অবাক। মেয়েটির মতলব কী? ট্রেনেই যেহেতু যাবে না, তাহলে এই রাতে স্টেশনে মেয়েটি কী করছে? হাজার প্রশ্ন আসে মনের ভেতর, যার উত্তর কেবল মেয়েটিই দিতে পারে।
দুই.
ঘড়িতে ১০টা ছুঁই ছুঁই। প্রতিদিন রাত ১২টা পর্যন্ত থাকলেও আজ আর থাকা চলবে না। এমন বাদলা দিনে কোনো খদ্দের আসে না। কেবল মিছে মিছে বসে কেরোসিন খরচ। দোকানটা বন্ধ করার আগে আরেকবার তাকালাম মেয়েটির দিকে। মেয়েটি এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। মনে হচ্ছে, কারো জন্য অপেক্ষা করছে মেয়েটি। কিছুটা ধীরপায়েই এগিয়ে গেলাম মেয়েটির দিকে। আমাকে দেখে ভূত দেখার মতোই চমকে উঠল। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, কী চান আপনি?
ইয়ে, মানে আমি অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করছি আপনি কারো জন্য অপেক্ষা করছেন। খোলা স্টেশন জনমানবশূন্য, তা ছাড়া এমন বাদলা দিনে একটি মেয়ে একা বসে থাকা নিরাপদ নয়।
মেয়েটি মনে হয় আমাকে কিছুটা বিশ্বাস করল। মেয়েটি মাথা নাড়িয়ে বলল, জি একজনের জন্য অপেক্ষা করছি, তবে মনে হচ্ছে সে আর আসবে না।
কার জন্য, আপনার কোনো আত্মীয়?
না, একজন অপদার্থ মানুষের জন্য।
ঠিক বুঝলাম না।
মেয়েটি আমার দিকে তাকাল। বাইরে বৃষ্টি, এখানে মেয়েটির চোখে বৃষ্টি। দুই মিলে যেন এক মহাপ্রলয় সৃষ্টি করেছে এই ধরায়। আমি যাকে ভালোবাসি তার জন্য। ও বুঝেছি, মানে আপনি ঘর থেকে পালিয়েছেন?
বলতে পারেন, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে সেটাই ভুল হয়েছে আমার।
তা এখন কোথায় যাবেন?
জানি না, কোথাও যেতে না পারলে ট্রেনের তলে ঝাঁপ দেবো।
মৃত্যুটাই কি সমাধান? এমনও হতে পারে, আপনার ভালোবাসার মানুষটি কোনো ভয়ানক বিপদে পড়েছে, তাই আসতে পারেনি।
মেয়েটি আমার কথায় যেন আশার আলো দেখতে পেল। বলল, সত্যি বলছেন আপনি?
সত্যি কি না জানি না, তবে মনে হলো।

তিন.
মেয়েটি আবার এদিক-ওদিক তাকাল, কাছে কোথাও শিয়াল ডাকছে। স্টেশনের কোণে এক শ’ পাওয়ারের একটি বাল্ব জ্বলছে। হঠাৎ লোডশেডিং হওয়ায় চার দিক অন্ধকারে ঢেকে গেল। মেয়েটি ভয়ে ভয়ে বলল, আপনি আছেন?
জি, আছি। ভয় পাবেন না। আলোর ব্যবস্থা করছি।
টর্চটা জ্বালালাম। মেয়েটির চোখেমুখে ভয়ের ছাপ।
রাত তো অনেক হলো, আমাকে যেতে হচ্ছে আপনি কি এখানেই থাকবেন? আপনি চাইলে আমি থাকার ব্যবস্থা করে দিতে পারি, কাল সকালে হয়তো আপনার ভালোবাসার মানুষটির সাথে যোগাযোগ হয়ে যাবে। মেয়েটি কোনো কথা বলল না।
আমি বাড়ির দিকে পা বাড়ালাম। মেয়েটি পেছন থেকে বলল, প্লিজ আমাকে একা ফেলে যাবেন না।
আমি পেছন ফিরে তাকালাম। তার মানে আপনার জন্য থাকার জায়গা ঠিক করে দেবো। মেয়েটি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়াল। চলুন তাহলে।
চার.
আগেই বলেছি, আমি ব্যাচেলর। একলা বাসায় থাকি। মেয়েটিকে একটি রুম দেখিয়ে বললাম, এই ঘরে আপনি থাকতে পারেন। মেয়েটি ব্যাগটা রেখে বসে পড়ল। কিছু খেয়েছেন?
না।
ঠিক আছে আপনি বসুন, নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন ব্যাচেলর মানুষ, নিজেকেই রান্না করতে হয়। তবে বেশিক্ষণ লাগবে না, আপনি ফ্রেশ হন, ওই সামনেই ওয়াশরুম।
চমৎকার একটা পারফিউমের ঘ্রাণ নাকে এসে ধাক্কা খেলো। পেছনে ফিরে মেয়েটির দিকে তাকালাম। এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলাম আমি। একটু আগে মেয়েটি সালোয়ার-কামিজ পরা থাকলেও এখন ফ্রেশ হয়ে একটা শাড়ি পরেছে।
আমার ভেতরের নরপশুটা জেগে উঠল। আজ রাতে সত্যিই প্রলয় হতে যাচ্ছে। মহাপ্রলয়।
পাঁচ.
অনেক কিছু ঘটে গেল কয়েক ঘণ্টার মধ্যে। আমার ভেতরের পুরুষত্বকে দেখাতে আমি হায়েনা হয়ে গেলাম। একটি মেয়ে রাতের অন্ধকারে একটি পুরুষের কাছে কতটা অসহায়, সেটা এই প্রথম বুঝলাম। মেয়েটি যে নিজেকে রা করার চেষ্টা করেনি তা কিন্তু নয়। কিন্তু আমার শরীরে যেন অসম শক্তি ভর করেছিল।
ছয়.
কেটে গেল অনেক দিন-মাস। সেদিন আকাশ ভরা মেঘ, দোকানের সামনে এসে বসল ছাদেক মাস্টার। কই দাও তো এক কাপ চা, চিনি কম। আমি চা বানিয়ে ছাদেক মাস্টারের দিকে এগিয়ে দিলাম। চায়ে চমুক দিয়ে ছাদেক মাস্টার বলল, তা দোকান করেই কি জীবন যাবে, বিয়াশাদি এইবার কিছু করো। আমি হেসে বললাম, তা আর বলব কী চাচা, মেয়েই পাই না পছন্দমতো।
বুঝেছি তুই আমার মতো, জোয়ান বয়সে আমিও এমন ছিলাম, সহজে মেয়ে পছন্দ হতো না, আমার বাবা-মা যে কত মেয়ের ফটো নিয়ে ঘুরত আমার পেছনেÑ এই বলে হাসতে লাগল।
আকাশের দিকে তাকিয়ে ছাদেক মাস্টার বলল, বৃষ্টি হবে নাকি আজ, এই অবেলায় বৃষ্টি। আমি বললামÑ হতে পারে, প্রকৃতির নিয়ম বোঝা বড় মুশকিল। ঠিক আছে, আমি উঠি রে। ছাদেক চাচা চলে গেল। ঠিকই বৃষ্টি শুরু হলো। ঝুমবৃষ্টি। এখন বিকেল, না সন্ধ্যা বোঝা মুশকিল।
স্টেশন একেবারেই ফাঁকা, ঠিক সেই দিনের মতো। আমি দ্রুত দোকান বন্ধ করে দিলাম। এমন বাদলা দিনে বসে থেকে লাভ নেই, তার চেয়ে বরং বাসায় গিয়ে আরামের একটা ঘুম দিই। অন্ধকার রেললাইন দিয়ে চলতে লাগলাম।
সাত.
এই পথ দিয়ে আজ ছয় বছর চলছি আমি, কখনো এমন লাগেনি। আবারো সেই শব্দ, এবার সাথে সাথে পেছনে ফিরে তাকালাম এবং টর্চ মারলাম, সাথে সাথে চমকে উঠলাম। একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে এবং মেয়েটি আমার খুব পরিচিত। কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললাম তুমি?
হ্যাঁ আমি। চিনতে পেরেছ তাহলে।
কিন্তু তুমি কিভাবে, তোমাকে তো আমি নিজ হাতে খুন করেছি।
মেয়েটি হেসে উঠল, আমি বিশ্বাস করেছিলাম তোমাকে। কিন্তু সেই বিশ্বাস তুমি রাখনি। আমার সব কিছু শেষ করে ছিলে, আমি তোমার কাছে কেবল প্রাণটুকু ভিক্ষা চেয়েছিলাম। কিন্তু তুমি দাওনি, রাতের অন্ধকারে আমাকে মেরে ফেলে রেখে গিয়েছিলে রেললাইনের ওপর।
আমি কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বললাম, আমার ভুল হয়ে গেছে, আমাকে মাফ করে দাও। মেয়েটি ক্ষোভ নিয়ে আমার দিকে তাকাল। ভুল মানুষ জীবনে একবারই করে, এই বলে মেয়েটি আমার দিকে এগিয়ে আসতে লাগল। আমি ভয়ে ছুটতে লাগলাম। পাগলের মতো ছুটতে লাগলাম। আমার পেছনে ট্রেনের ভয়ানক শব্দ। তবুও আমি দৌড়াচ্ছি, হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে দৌড়াচ্ছি।
অবশেষে দানবের মতো ট্রেনটা এসে ধাক্কা মারল আমায়। একটা অট্টোহাসির শব্দ কানে ভেসে এলো। তারপর সব অন্ধকার।
আট.
জংতলার স্টেশন থেকে কিছুটা দূরে মানুষের জটলা। একজন লোক ট্রেনে কাটা পড়েছে, তবে লোকটা অজ্ঞাত নয়। সবাই চিনতে পারল লোকটা স্টেশনের চা-পান বিক্রেতা শাফী মাহমুদ।
sranontojugantor@gmail.com

No comments:

Post a Comment