22-07-2014 daily somokal- suhrid
এক মুঠো আনন্দের খোঁজে
সোহানুর রহমান অনন্ত
হঠাৎ বাসটা থেমে যাওয়ায় ঝাঁকুনি খেলাম। ঘুমে চোখটা লেগে এসেছিল। কন্ডাক্টর এসে বলল, চাকা পাংচার হয়ে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগবে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম, গ্রাম্য জনপদ ঘুটঘুটে অন্ধকার। যাত্রীরা অনেকেই গাড়ি থেকে নেমে হাঁটাহাঁটি শুরু করল। কাছেই একটা বাজার আছে, টিমটিমে আলো জ্বলছে। একটা সিগারেট খাওয়া প্রয়োজন। বাস থেমে নেমে হেলপারের কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম কতক্ষণ লাগবে? সে জানাল, বিশ-পঁচিশ মিনিট। আমি বাজারের দিকে পা বাড়ালাম। আমার মাথার ওপর দিয়ে চলতে লাগল অসংখ্য জোনাকি।
২.
দু'তিনটে দোকান নিয়ে এই বাজার। চা-বিস্কুট সবই পাওয়া যায়। একটা সিগারেট নিয়ে সবেমাত্র বসেছি, এমন সময় একজন লোককে দেখে চমকে উঠলাম। লোকটি ছেঁড়া একটা জামা হাতে বসে আছে। মুখভর্তি দাড়ি, মনে হয় বহুদিন তাতে যত্ন নেওয়া হয়নি। গায়ে পোশাক নেই, পরনে কেবল একটি পুরনো লুঙ্গি। দোকানে এছাড়া আরও দু'তিনজন ছিল। আমি ভিক্ষুক ভেবে পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করে এগিয়ে দিলাম। লোকটা টাকা না নিয়ে জামাটা আমাকে দেখিয়ে কী যেন বলতে লাগল। মোটামুটি বুঝতে পারলাম, লোকটার কথা বলার ক্ষমতা নেই। এবং সে জামাটা দেখিয়ে কী বোঝাতে চাইছে আমি সেই কথা বুঝতে পারছি না। হারিকেনের হালকা আলোয় জামাটার গায়ে রক্তের দাগ দেখতে পেলাম। দেখতে পেলাম লোকটার চোখে পানি। শিউরে উঠলাম, কিছুই যেন বুঝতে পারছি না আমি। কিছুই না।
৩.
লোকটা উঠে চলে গেল। হেলে-দুলে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল একসময়। আমি দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম লোকটার ব্যাপারে। দোকানি প্রথমে কিছু বলতে রাজি না হলেও আমার আগ্রহ দেখে বলতে শুরু করল। আজ থেকে আট বছর আগের কথা। ঠিক এমনই ঈদের আগেরদিন রাতে এখানে একটি বাস অ্যাকসিডেন্ট হয়। রাতের অন্ধকারে ভয়ানক শব্দে জেগে ওঠে গ্রামবাসী। সবাই আলো নিয়ে এগিয়ে আসে, ততক্ষণে অনেক তাজা প্রাণ শেষ। বাসটি রাস্তা থেকে ছিটকে নিচে পড়ে গিয়েছিল। বাস থেকে এক এক লাশ বের করতে লাগল গ্রামের লোকজন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ চলে এলো। একটি ছয় বছরের মেয়েকে বের করা হলো, তার বাবা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। কেবল এই দু'জনকেই জীবিত মনে হলো। সবাই মিলে নিয়ে গেল হাসপাতালে। কিন্তু হলো না। দোকানির চোখেও জল নেমে এলো। আমার চোখেও জল।
৪.
মেয়েটি মারা গেল। বাবা বেঁচে গেলেও সেই কথা শোনার পর আর কোনো কথা বলেনি। বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। আজও তেমনি আছে। মেয়েটির রক্তাক্ত জামা নিয়ে ঘুরেফিরে এখানে। অচেনা কাউকে দেখলেই জামাটা দেখায়। খুঁজে ফেরে মেয়েকে। কেউ আজও খোঁজ করতে আসেনি এ মানুষটির। কথা না বলতে পারায় কেউ জানতেও পারেনি কোথায় তার ঠিকানা। কেউ কিছু বললে নীরবে শুনে যায়, কেবল মেয়েটির জামার দিকে তাকিয়ে থাকে। গ্রামের মানুষের ধারণা, লোকটা পাগল হয়ে গেছে। কিন্তু আমার মনে হয় আদরের সন্তানকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে বাবা। এমন সময় পেছন থেকে হেলপার এসে বলল, ভাই গাড়ি তো ছাইড়া দিতাছে আর আপনি এখানে বইসা আছেন? তাড়াতাড়ি আসেন। কখন যে চোখে জল এসে গেছে নিজেও জানি না। এটাই বোধহয় বাবার ভালোবাসা। দোকান থেকে উঠে গাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম। পেছনে ফিরে একবার তাকালাম। লোকটা যেদিকে চলে গেছে সেই দিকে। কোথাও কেউ নেই। সবই শূন্য।
৫.
সমস্ত পথ মনটা খুব ভীষণ্ন ছিল। লোকটার জন্য খুব খারাপ লাগছিল। ঈদের ভোরের আলো এসে পড়েছে বাসের ভেতর। তবুও যেন আঁধার কাটেনি আমার চোখের সামনে। আমি যেন এখনও দেখছি, অন্ধকারের বুক চিরে একজন বাবা তার হারানো মৃত মেয়ের রক্তাক্ত জামা নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হেঁটে যাচ্ছে। এই আটটি বছর প্রতিটি ঈদ তার কাছে শূন্যতা নিয়ে এসেছে। এক মুঠো আনন্দও জোটেনি। ঈদের এই আনন্দে হয়তো সবাই মেতে থাকবে, তারই আড়ালে কেউ কেঁদে যাবে একা একা। লোকটার জন্য খুব খারাপ লাগছিল। জানি না আর কখনও দেখব কি-না। তবে এমন ভাগ্য যেন আর কোনো বাবার না হয়। এটা খুব কষ্টের, অনেক কষ্টের।
হসুহৃদ ঢাকা
এক মুঠো আনন্দের খোঁজে
সোহানুর রহমান অনন্ত
হঠাৎ বাসটা থেমে যাওয়ায় ঝাঁকুনি খেলাম। ঘুমে চোখটা লেগে এসেছিল। কন্ডাক্টর এসে বলল, চাকা পাংচার হয়ে গেছে। বেশ কিছুক্ষণ সময় লাগবে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকালাম, গ্রাম্য জনপদ ঘুটঘুটে অন্ধকার। যাত্রীরা অনেকেই গাড়ি থেকে নেমে হাঁটাহাঁটি শুরু করল। কাছেই একটা বাজার আছে, টিমটিমে আলো জ্বলছে। একটা সিগারেট খাওয়া প্রয়োজন। বাস থেমে নেমে হেলপারের কাছে গিয়ে জানতে চাইলাম কতক্ষণ লাগবে? সে জানাল, বিশ-পঁচিশ মিনিট। আমি বাজারের দিকে পা বাড়ালাম। আমার মাথার ওপর দিয়ে চলতে লাগল অসংখ্য জোনাকি।
২.
দু'তিনটে দোকান নিয়ে এই বাজার। চা-বিস্কুট সবই পাওয়া যায়। একটা সিগারেট নিয়ে সবেমাত্র বসেছি, এমন সময় একজন লোককে দেখে চমকে উঠলাম। লোকটি ছেঁড়া একটা জামা হাতে বসে আছে। মুখভর্তি দাড়ি, মনে হয় বহুদিন তাতে যত্ন নেওয়া হয়নি। গায়ে পোশাক নেই, পরনে কেবল একটি পুরনো লুঙ্গি। দোকানে এছাড়া আরও দু'তিনজন ছিল। আমি ভিক্ষুক ভেবে পকেট থেকে পঞ্চাশ টাকার একটা নোট বের করে এগিয়ে দিলাম। লোকটা টাকা না নিয়ে জামাটা আমাকে দেখিয়ে কী যেন বলতে লাগল। মোটামুটি বুঝতে পারলাম, লোকটার কথা বলার ক্ষমতা নেই। এবং সে জামাটা দেখিয়ে কী বোঝাতে চাইছে আমি সেই কথা বুঝতে পারছি না। হারিকেনের হালকা আলোয় জামাটার গায়ে রক্তের দাগ দেখতে পেলাম। দেখতে পেলাম লোকটার চোখে পানি। শিউরে উঠলাম, কিছুই যেন বুঝতে পারছি না আমি। কিছুই না।
৩.
লোকটা উঠে চলে গেল। হেলে-দুলে অন্ধকারে মিলিয়ে গেল একসময়। আমি দোকানিকে জিজ্ঞেস করলাম লোকটার ব্যাপারে। দোকানি প্রথমে কিছু বলতে রাজি না হলেও আমার আগ্রহ দেখে বলতে শুরু করল। আজ থেকে আট বছর আগের কথা। ঠিক এমনই ঈদের আগেরদিন রাতে এখানে একটি বাস অ্যাকসিডেন্ট হয়। রাতের অন্ধকারে ভয়ানক শব্দে জেগে ওঠে গ্রামবাসী। সবাই আলো নিয়ে এগিয়ে আসে, ততক্ষণে অনেক তাজা প্রাণ শেষ। বাসটি রাস্তা থেকে ছিটকে নিচে পড়ে গিয়েছিল। বাস থেকে এক এক লাশ বের করতে লাগল গ্রামের লোকজন। খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে পুলিশ চলে এলো। একটি ছয় বছরের মেয়েকে বের করা হলো, তার বাবা তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। কেবল এই দু'জনকেই জীবিত মনে হলো। সবাই মিলে নিয়ে গেল হাসপাতালে। কিন্তু হলো না। দোকানির চোখেও জল নেমে এলো। আমার চোখেও জল।
৪.
মেয়েটি মারা গেল। বাবা বেঁচে গেলেও সেই কথা শোনার পর আর কোনো কথা বলেনি। বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। আজও তেমনি আছে। মেয়েটির রক্তাক্ত জামা নিয়ে ঘুরেফিরে এখানে। অচেনা কাউকে দেখলেই জামাটা দেখায়। খুঁজে ফেরে মেয়েকে। কেউ আজও খোঁজ করতে আসেনি এ মানুষটির। কথা না বলতে পারায় কেউ জানতেও পারেনি কোথায় তার ঠিকানা। কেউ কিছু বললে নীরবে শুনে যায়, কেবল মেয়েটির জামার দিকে তাকিয়ে থাকে। গ্রামের মানুষের ধারণা, লোকটা পাগল হয়ে গেছে। কিন্তু আমার মনে হয় আদরের সন্তানকে হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে বাবা। এমন সময় পেছন থেকে হেলপার এসে বলল, ভাই গাড়ি তো ছাইড়া দিতাছে আর আপনি এখানে বইসা আছেন? তাড়াতাড়ি আসেন। কখন যে চোখে জল এসে গেছে নিজেও জানি না। এটাই বোধহয় বাবার ভালোবাসা। দোকান থেকে উঠে গাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম। পেছনে ফিরে একবার তাকালাম। লোকটা যেদিকে চলে গেছে সেই দিকে। কোথাও কেউ নেই। সবই শূন্য।
৫.
সমস্ত পথ মনটা খুব ভীষণ্ন ছিল। লোকটার জন্য খুব খারাপ লাগছিল। ঈদের ভোরের আলো এসে পড়েছে বাসের ভেতর। তবুও যেন আঁধার কাটেনি আমার চোখের সামনে। আমি যেন এখনও দেখছি, অন্ধকারের বুক চিরে একজন বাবা তার হারানো মৃত মেয়ের রক্তাক্ত জামা নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে হেঁটে যাচ্ছে। এই আটটি বছর প্রতিটি ঈদ তার কাছে শূন্যতা নিয়ে এসেছে। এক মুঠো আনন্দও জোটেনি। ঈদের এই আনন্দে হয়তো সবাই মেতে থাকবে, তারই আড়ালে কেউ কেঁদে যাবে একা একা। লোকটার জন্য খুব খারাপ লাগছিল। জানি না আর কখনও দেখব কি-না। তবে এমন ভাগ্য যেন আর কোনো বাবার না হয়। এটা খুব কষ্টের, অনেক কষ্টের।
হসুহৃদ ঢাকা
No comments:
Post a Comment