Aj 22-11-2014 daily nayadiganter priojon-a amar golpo
বুকপকেট
সোহানুর রহমান অনন্ত
ভাঁজ করা চিঠিটা সব সময় বুক পকেটে রাখে মুকুল। বেশ কয়েকবার ভেবেছে এটা চৈতিকে দিয়ে দেবে। কিন্তু সেই সুসময়টা যেন আসি আসি করেও আর আসে না। মুকুল চৈতির ছোট বোনকে পড়ায়। পড়ার ফাঁকে যতটুকু সম্ভব আড়চোখে তাকায় দরজার দিকে। পর্দার ফাঁকে মাঝে মাঝে চৈতির এপাশ-ওপাশ আসা যাওয়া চোখে পড়ে। কানটা খাড়া করে রাখে, চৈতির কণ্ঠ শোনার জন্য। মাঝে মাঝে চা হাতে চৈতি রুমে প্রবেশ করে। আসে কিন্তু দাঁড়ায় না এক মুহূর্তের জন্য। এ যেন উড়ে আসা এক টুকরো মেঘ। আজো মুকুল বুকপকেটে চিঠিটা সযতেœ নিয়ে প্রবেশ করেছে চৈতিদের বাসায়।
বুক পকেটে হাত রাখে মুকুল। রিকশাটা যেন খুব দ্রুত চলছে। আড়চোখে আবারো চৈতিকে দেখা, লাল টিপটার পাশ ঘেঁষে এক ফোঁটা ঘাম এসেছে জমেছে। যেন চাঁদের পাশে এক টুকুরো মেঘ। আমি জানি না আমার এই তাকানোটা চৈতি বুঝতে পেরেছে কি না। হঠাৎ চৈতি বলে ওঠে, স্যার, একটা কথা বলি?
মুকুল সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত হয়ে যায়। কাঁপাকাঁপা গলায় বলে কী কথা? একটা কথা জানেন তো, মেয়েরা ছেলেদের মনের কথা খুব সহজে বুঝতে পারে। আপনি বোধহয় আমাকে কিছু বলতে চাইছেন।
মুকুলের বুকটা ধপাস করে ওঠে। বুকপকেটে আবার ডান হাতটা রাখে। চৈতি আবার বলে ওঠে, কিছু বলছেন না যে?
ইয়ে মানে... তোমাকে একটা জিনিস দেবো, তবে কথা দাও এই বিষয়ে তুমি কাউকে কিছু বলবে না। চৈতি মুকুলের দিকে তাকাল। ওর কাজল কালো চোখে অমৃতের সুখ। হালকা মাথাটা নাড়িয়ে বলল, ওকে, বলব না।
মুকুল বুকপকেট থেকে চিঠিটা বের করে চৈতির হাতে দিয়ে দেয়। তারপর আর একটিবারের জন্যও লজ্জায় তাকাতে পারে না চৈতির দিকে। চৈতি মিটিমিটি হেসে বলে, পুরুষ মানুষের এতটা লজ্জা পাওয়া কি ঠিক? মুকুল কিছুই বলতে পারে না উত্তরে। চিঠিটা চৈতির হাতে সাহস করে দিতে পেরেছে, এটাই তার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। শেষবারের মতো মুকুল আড়চোখে চৈতির দিকে তাকায়। দেখে চৈতি মিটিমিটি হাসছে।
এখন রোজ একটি করে চিঠি বুকপকেটে করে নিয়ে আসে মুকুল। চৈতি চা দেয়ার নাম করে এসে চিঠিটা নিয়ে যায়। আবার সেগুলোর উত্তর দেয়। চমৎকার করে গুছিয়ে লেখে প্রতিটি লাইন। যেন একটি লাইনই একটি ভালোবাসার গল্প। চৈতির জীবনানন্দ দাশের কবিতা পছন্দ। মুকুল তাই জীবনানন্দের কবিতার লাইন কেটে চিঠিটা আরো বড় করে দেয়। এভাবেই জীবনের কিছুটা বেলা কেটে গেছে মুকুলের। বুকপকেটটা যেন ভালোবাসার ডাকবাক্স। প্রতিটি চিঠি জমা থাকে তার ভেতর। সেদিন বিকেলে বাসায় ঢুকতেই দেখে। কী একটা বিষয় নিয়ে চৈতির মা চৈতিকে খুব বকাঝকা করছে। মুকুলকে দেখে অবশ্য তাড়া ভেতরের রুমে চলে যায়। নূপুরের কাছ থেকে বিস্তারিত শুনতে পায় মুকুল।
চৈতিকে এলাকার একটি ছেলে বেশ কিছু দিন ধরে বিরক্ত করছে। কিন্তু চৈতির মায়ের ধারণা, এতে চৈতিও যোগ আছে। সে কারণেই বকাঝকা করছে। কথাটা শুনে কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে যায় মুকুল। সে দিনের পর থেকেই চৈতির মা চৈতির বিয়ে দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগে। ঘটনাচক্রে মুকুল নিজেই সাহস করে প্রস্তাব দেয়। চৈতির মা এতে আর আপত্তি করে না। সব কিছুই চলছিল সাজানো গোছানো। হঠাৎ বিয়ের দুই দিন আগে চৈতি নিখোঁজ হয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করা হয়, কিন্তু কোথাও নেই। মুকুল মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। বুকের বাম পাশটায় চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে। ১০ দিন পর চৈতিকে পাওয়া যায় ঢাকার উত্তরায়। চৈতি ধর্ষিত হয়েছে।
সে দিন কলেজ থেকে ফেরার পথে চৈতিকে তুলে নিয়ে যায়, এলাকার বখাটে সেই ছেলেটি। তারপর উত্তরায় একটি নির্জন ফ্যাটে আটকে রেখে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। সেখান থেকে চৈতি পালিয়ে যায় এবং আশঙ্কাজনক অবস্থায় লোকজন ওকে হাসপাতালে ভর্তি করে।
জ্ঞান ফেরার পর এসবই বলেছে চৈতি। কিছুই লুকায়নি। চৈতির মা, আড়ালে ঢেকে নিয়ে সব কথাই বলে মুকুলকে। তিনি ভেবেছিলেন হয়তো মুকুল শোনার পরে বিয়েটা ভেঙে দেবে। এটা ভাবার যুক্তিগত কারণও আছে।
কোনো পুরুষ জেনেশুনে চায় না একজন ধর্ষিতাকে বিয়ে করতে। কথাগুলো শুনে মুকুল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। চৈতির মায়ের চোখে পানি, এমন দুর্দিন দেখতে হবে, তিনি কল্পনাও করেননি। মুকুল চৈতির মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, আমাদের দেশে বেশির ভাগ নারী এমন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কিছু প্রকাশ হচ্ছে কিছু হচ্ছে না। এর জন্য অবশ্য সমাজের উঠতি বয়সের যুবকদের অবক্ষয়কই দায়ী।
একজন ধর্ষিতা সমাজের বাইরের কেউ নন। তাকে পুনরায় ভালোবেসে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব। চৈতিকে আমি ভালোবেসেছি, যেমনটা প্রথমে বেসেছিলাম তেমনটি এখনো বাসি এবং ভবিষ্যতেও বেসে যাবো।
মানুষের জীবনে অনেক রকম দুর্ঘটনা ঘটে। এসব মেনে নিয়েই মানুষকে এগিয়ে যেতে হয়। চৈতিকে ছেড়ে চলে গেলে আমার মন আমাকে কখনো সুখী হতে দেবে না। এই বলে মুকুল চৈতির বেডের দিকে পা বাড়াল। ঝাপসা চোখে চৈতির মা তাকিয়ে রইলেন মুকুলের দিকে। চৈতির মাথার কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল মুকুল। চৈতি ঘুমিয়ে আছে। বুকপকেটে আজো একটা চিঠি রয়েছে। চৈতি বলেছে বিয়ের পরও রোজ একটি করে চিঠি দিতে হবে।
সাথে জীবনানন্দের কবিতা। মুকুল বুকপকেট থেকে চিঠিটা বের করে চৈতির বালিশের নিচে রাখে। তারপর নিঃশব্দে বেরিয়ে যায়। বুকের শূন্যতাটা মিটে গেছে চৈতির মুখ দেখে।
বারান্দায় দাঁড়াতেই মেঘলা আকাশটা চোখে পড়ল। মুকুল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আকাশের দিকে।
বুকপকেট
সোহানুর রহমান অনন্ত
ভাঁজ করা চিঠিটা সব সময় বুক পকেটে রাখে মুকুল। বেশ কয়েকবার ভেবেছে এটা চৈতিকে দিয়ে দেবে। কিন্তু সেই সুসময়টা যেন আসি আসি করেও আর আসে না। মুকুল চৈতির ছোট বোনকে পড়ায়। পড়ার ফাঁকে যতটুকু সম্ভব আড়চোখে তাকায় দরজার দিকে। পর্দার ফাঁকে মাঝে মাঝে চৈতির এপাশ-ওপাশ আসা যাওয়া চোখে পড়ে। কানটা খাড়া করে রাখে, চৈতির কণ্ঠ শোনার জন্য। মাঝে মাঝে চা হাতে চৈতি রুমে প্রবেশ করে। আসে কিন্তু দাঁড়ায় না এক মুহূর্তের জন্য। এ যেন উড়ে আসা এক টুকরো মেঘ। আজো মুকুল বুকপকেটে চিঠিটা সযতেœ নিয়ে প্রবেশ করেছে চৈতিদের বাসায়।
বুক পকেটে হাত রাখে মুকুল। রিকশাটা যেন খুব দ্রুত চলছে। আড়চোখে আবারো চৈতিকে দেখা, লাল টিপটার পাশ ঘেঁষে এক ফোঁটা ঘাম এসেছে জমেছে। যেন চাঁদের পাশে এক টুকুরো মেঘ। আমি জানি না আমার এই তাকানোটা চৈতি বুঝতে পেরেছে কি না। হঠাৎ চৈতি বলে ওঠে, স্যার, একটা কথা বলি?
মুকুল সম্পূর্ণ অপ্রস্তুত হয়ে যায়। কাঁপাকাঁপা গলায় বলে কী কথা? একটা কথা জানেন তো, মেয়েরা ছেলেদের মনের কথা খুব সহজে বুঝতে পারে। আপনি বোধহয় আমাকে কিছু বলতে চাইছেন।
মুকুলের বুকটা ধপাস করে ওঠে। বুকপকেটে আবার ডান হাতটা রাখে। চৈতি আবার বলে ওঠে, কিছু বলছেন না যে?
ইয়ে মানে... তোমাকে একটা জিনিস দেবো, তবে কথা দাও এই বিষয়ে তুমি কাউকে কিছু বলবে না। চৈতি মুকুলের দিকে তাকাল। ওর কাজল কালো চোখে অমৃতের সুখ। হালকা মাথাটা নাড়িয়ে বলল, ওকে, বলব না।
মুকুল বুকপকেট থেকে চিঠিটা বের করে চৈতির হাতে দিয়ে দেয়। তারপর আর একটিবারের জন্যও লজ্জায় তাকাতে পারে না চৈতির দিকে। চৈতি মিটিমিটি হেসে বলে, পুরুষ মানুষের এতটা লজ্জা পাওয়া কি ঠিক? মুকুল কিছুই বলতে পারে না উত্তরে। চিঠিটা চৈতির হাতে সাহস করে দিতে পেরেছে, এটাই তার কাছে স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। শেষবারের মতো মুকুল আড়চোখে চৈতির দিকে তাকায়। দেখে চৈতি মিটিমিটি হাসছে।
এখন রোজ একটি করে চিঠি বুকপকেটে করে নিয়ে আসে মুকুল। চৈতি চা দেয়ার নাম করে এসে চিঠিটা নিয়ে যায়। আবার সেগুলোর উত্তর দেয়। চমৎকার করে গুছিয়ে লেখে প্রতিটি লাইন। যেন একটি লাইনই একটি ভালোবাসার গল্প। চৈতির জীবনানন্দ দাশের কবিতা পছন্দ। মুকুল তাই জীবনানন্দের কবিতার লাইন কেটে চিঠিটা আরো বড় করে দেয়। এভাবেই জীবনের কিছুটা বেলা কেটে গেছে মুকুলের। বুকপকেটটা যেন ভালোবাসার ডাকবাক্স। প্রতিটি চিঠি জমা থাকে তার ভেতর। সেদিন বিকেলে বাসায় ঢুকতেই দেখে। কী একটা বিষয় নিয়ে চৈতির মা চৈতিকে খুব বকাঝকা করছে। মুকুলকে দেখে অবশ্য তাড়া ভেতরের রুমে চলে যায়। নূপুরের কাছ থেকে বিস্তারিত শুনতে পায় মুকুল।
চৈতিকে এলাকার একটি ছেলে বেশ কিছু দিন ধরে বিরক্ত করছে। কিন্তু চৈতির মায়ের ধারণা, এতে চৈতিও যোগ আছে। সে কারণেই বকাঝকা করছে। কথাটা শুনে কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে যায় মুকুল। সে দিনের পর থেকেই চৈতির মা চৈতির বিয়ে দেয়ার জন্য উঠেপড়ে লাগে। ঘটনাচক্রে মুকুল নিজেই সাহস করে প্রস্তাব দেয়। চৈতির মা এতে আর আপত্তি করে না। সব কিছুই চলছিল সাজানো গোছানো। হঠাৎ বিয়ের দুই দিন আগে চৈতি নিখোঁজ হয়ে যায়। অনেক খোঁজাখুঁজি করা হয়, কিন্তু কোথাও নেই। মুকুল মানসিকভাবে ভেঙে পড়ে। বুকের বাম পাশটায় চিনচিনে ব্যথা অনুভব করে। ১০ দিন পর চৈতিকে পাওয়া যায় ঢাকার উত্তরায়। চৈতি ধর্ষিত হয়েছে।
সে দিন কলেজ থেকে ফেরার পথে চৈতিকে তুলে নিয়ে যায়, এলাকার বখাটে সেই ছেলেটি। তারপর উত্তরায় একটি নির্জন ফ্যাটে আটকে রেখে পালাক্রমে ধর্ষণ করে। সেখান থেকে চৈতি পালিয়ে যায় এবং আশঙ্কাজনক অবস্থায় লোকজন ওকে হাসপাতালে ভর্তি করে।
জ্ঞান ফেরার পর এসবই বলেছে চৈতি। কিছুই লুকায়নি। চৈতির মা, আড়ালে ঢেকে নিয়ে সব কথাই বলে মুকুলকে। তিনি ভেবেছিলেন হয়তো মুকুল শোনার পরে বিয়েটা ভেঙে দেবে। এটা ভাবার যুক্তিগত কারণও আছে।
কোনো পুরুষ জেনেশুনে চায় না একজন ধর্ষিতাকে বিয়ে করতে। কথাগুলো শুনে মুকুল কিছুক্ষণ চুপ করে থাকে। চৈতির মায়ের চোখে পানি, এমন দুর্দিন দেখতে হবে, তিনি কল্পনাও করেননি। মুকুল চৈতির মায়ের দিকে তাকিয়ে বলে, আমাদের দেশে বেশির ভাগ নারী এমন নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। কিছু প্রকাশ হচ্ছে কিছু হচ্ছে না। এর জন্য অবশ্য সমাজের উঠতি বয়সের যুবকদের অবক্ষয়কই দায়ী।
একজন ধর্ষিতা সমাজের বাইরের কেউ নন। তাকে পুনরায় ভালোবেসে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা প্রতিটি মানুষের দায়িত্ব। চৈতিকে আমি ভালোবেসেছি, যেমনটা প্রথমে বেসেছিলাম তেমনটি এখনো বাসি এবং ভবিষ্যতেও বেসে যাবো।
মানুষের জীবনে অনেক রকম দুর্ঘটনা ঘটে। এসব মেনে নিয়েই মানুষকে এগিয়ে যেতে হয়। চৈতিকে ছেড়ে চলে গেলে আমার মন আমাকে কখনো সুখী হতে দেবে না। এই বলে মুকুল চৈতির বেডের দিকে পা বাড়াল। ঝাপসা চোখে চৈতির মা তাকিয়ে রইলেন মুকুলের দিকে। চৈতির মাথার কাছে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল মুকুল। চৈতি ঘুমিয়ে আছে। বুকপকেটে আজো একটা চিঠি রয়েছে। চৈতি বলেছে বিয়ের পরও রোজ একটি করে চিঠি দিতে হবে।
সাথে জীবনানন্দের কবিতা। মুকুল বুকপকেট থেকে চিঠিটা বের করে চৈতির বালিশের নিচে রাখে। তারপর নিঃশব্দে বেরিয়ে যায়। বুকের শূন্যতাটা মিটে গেছে চৈতির মুখ দেখে।
বারান্দায় দাঁড়াতেই মেঘলা আকাশটা চোখে পড়ল। মুকুল এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো আকাশের দিকে।
No comments:
Post a Comment