আজ ১১-০৮-২০১৫ দৈনিক সমকালের সুহৃদ-এ, লেখা এবং আঁকা দুটোই আমার
লজিং মাস্টার
সোহানুর রহমান অনন্ত
লজিং থাকাটা অনেকটা ঘরজামাইয়ের মতো। মুখবুজে সবকিছু সহ্য করতে হয়। আমার কথা শুনে মুখ টিপে হাসল পল্লবী। হাসলে ওর গালে টোল পড়ে, বড় টোল। হাসছ কেন? হাসির কিছু বলেছি। নাহ্ বলেননি, এমনি হাসলাম। এক কাপ চা দিয়ে গেল মুকুলের মা। চায়ের ধোঁয়া উঠছে কুণ্ডলী পাকিয়ে, সেই ধোঁয়া ঝাপসা করে দেয় সুন্দর মুখটাকে। পাশে বসে অঙ্ক করছে টুনি। ক্লাস ফাইভে পড়ে, পল্লবী এবার কলেজে উঠেছে। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে, আলাদা হয়ে গেছে বছর দুয়েক আগে। মাঝে মধ্যে আসে। ইচ্ছে হলে হাতখরচ দেয়, না হলে দেয় না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পল্লবীর মা খেটে মরে। মুখ দিয়ে তবু একবারের জন্যও স্বামীর নামে অভিশাপ দেয় না। এখানেই বোধহয় স্ত্রী হওয়া সার্থকতা। এমন ভালো মানুষটিকে নিয়ে কেন সংসার করল না, তা আমার বোধগম্য নয়। এমন একটা সংসারে লজিং থাকাও লজ্জার ব্যাপার। কিন্তু উপায় নেই, ভালো একটা চাকরি না পেয়ে কোথাও যাচ্ছি না। স্যার আপনি কি বিকেলে ফ্রি আছেন? পল্লবীর কথায় নিজেকে ফিরে পেলাম। আছি কেন বল তো? আমার সঙ্গে একটু যেতে হবে, কি যাবেন না? কোথায়? গেলেই দেখতে পাবেন। ঠিক আছে যাব। আবার টোল পড়া ঘালের হাসি চোখ ঝাপসা করে দিল।
২.
রিকশা স্টেশন রোড ধরে চলছে। আমরা যাচ্ছি কোথায় সেটাই তো বললে না? কোথাও যাচ্ছি না, আপনাকে নিয়ে রিকশায় ঘুরতে ইচ্ছে হলো, এমনি বললে তো আর আসতেন না। মানে কি? মানে-টানে কিছু নেই, ঘুরতে ইচ্ছে হলো ঘুরছি। তাই বলে আমাকে বলবে না? না বলব না, বলিনি তো কী হয়েছে। হুটহাট রেগে যায় পল্লবী, এখনও মনে হয় রেগে গেছে। আমি কিছুই বললাম না, রাগী মেয়েদের বেশি রাগাতে নেই। বেশি রেগে গেলে জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। এই তোমার রিকশা ঘুরিয়ে আগের জায়গা নিয়ে যাও। বুঝলাম বড্ড বেশি রেগে গেছে। রিকশাওয়ালা কী বুঝল জানি না, সে আবার ঘুরিয়ে ফেলল। বাড়ির সামনে আসতেই রিকশা থেকে নেমে সোজা বাড়ির ভেতর চলে গেল পল্লবী। আমি হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তার দিকে গেলাম। লাইব্রেরিতে একটু ঢুঁ মারব। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মনের পর্দায় ভেসে উঠছে। যখন বাসায় ফিরলাম ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গেছে। টিপটিপ বৃষ্টি ঝরছিল, এখন বড় বড় ফোঁটা আকারে পড়তে শুরু করেছে। বাসায় ফিরতেই শুনি পল্লবী সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে। অদ্ভুত ব্যাপার, এটা আবার কখন ঘটল। টুনি আর কিছুই বলল না, পল্লবীর ঘরে চলে গেল। শব্দ করে একটা কাঁশি দিয়ে ঘরে ঢুকলাম। পল্লবীর মাথায় ব্যান্ডেজ, আমাকে দেখে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। পল্লবীর মা কি কিচেনে চলে গেল। সেই সুযোগে জিজ্ঞেস করলাম, এত পাগলী কেন তুমি। কোনো উত্তর নেই। আচ্ছা এখানে রাগ করার মতো কী হয়েছে? তারপরও কোনো উত্তর নেই। আমি চলে আসব এমন সময় বলল, আমি আপনার ওপর রাগ করিনি। আমার মনটা এমনিতেই ভালো নেই। বিশ্বাস হচ্ছে না। সত্যি, এই দেখুন আমি হাসছি। টোল পড়া হাসিমাখা একটা মুখ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আর আমি মার্বেলের মূর্তির মতো তাকিয়ে রইলাম।
৩.
পল্লবীকে ভালোবাসি কি-না জানি না। তবে ওর কথা ভাবতে ভালোলাগে। মাঝে মধ্যে জ্যোৎস্নামাখা রাত দেখতে ইচ্ছে করে। হাতে হাত রেখে রেললাইনের পথ ধরে বহুদূর হেঁটে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কেন যেন একটা দেয়াল অনুভব করি। পল্লবীর মা আমাকে অগাত বিশ্বাস করে, আর পল্লবীও তো আমাকে কোনো গ্রিন সিগনাল দেয়নি। সুতরাং একতরফা ভালোবাসার কোনো মানে হয় না। দিনগুলো যেন খাঁচায় বন্দিপাখির মতোই কাটতে লাগল আমার। সকাল-বিকেল পল্লবীর হাসি আমার স্নায়ুতে আগুন ধরিয়ে দেয়। নিজেকে আড়াল করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই আমার। বিশ্বাসে আগুন দেওয়া পাপ, তাই নিজ থেকেই সরে যেতে চাইছিলাম। এরই মধ্যে এক বিকেলে পিয়ন এসে একটা চিঠি ধরিয়ে দিল। আমার চাকরি হয়ে গেছে। টুনি খুশিতে একটা লাফ দিয়ে বলল, ভাই মিষ্টি খাওয়াবেন না? আমি হেসে বললাম খাওয়াব।
কাশি দিয়ে আবার ঘরে ঢুকলাম। টুনি এতক্ষণে ঢোল পিটিয়ে সব বলে দিয়েছে। তারপরও আমি বললাম, একটা চাকরি হয়ে গেছে আমার। কয়েকদিন পরই চলে যাব এ বাড়ি ছেড়ে। পল্লবীর মা অনুরোধের সুরে বলল, পল্লবীর বিয়ের সময় ডাকলে আসতে হবে কিন্তু। আমি নীরবে মাথা নাড়িয়ে বলেছি আসব, অবশ্যই আসব। পল্লবী কিছুই বলেনি, ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে। সামনের চুলগুলো বাতাসে এদিক-সেদিক নড়াচড়া করছে। টুনি বলল, স্যার আমার বিয়ের সময়ও কিন্তু আসতে হবে। ওর কথা শুনে সবাই হেসেছিল, হাসেনি কেবল পল্লবী। ওর মুখে অন্য কিছু ফুটে উঠেছে, যা পড়তে পাড়ি কিন্তু পড়ব না। পড়লে বিপদ আরও বেড়ে যাবে। ব্যাগ কাঁধে যখন নেমে পড়ি, তখন পল্লবীকে দেখতে পাইনি। টুনির চোখে জল, পল্লবীর মায়ের চোখেও জল। এতটা দিন তাদের বাসায় লজিং ছিলাম, আমাকে কোনোদিন পরের ছেলের মতো দেখেননি তিনি। তাই বোধকরি কষ্ট হচ্ছিল।
রাস্তায় হলদে বাতির নিচে দাঁড়িয়ে একবার ফিরে তাকিয়েছিলাম বাড়িটির দিকে। পল্লবী দাঁড়িয়ে ছিল বারান্দার শিক ধরে। ওর চোখ ভরতি বৃষ্টি, অনেকদিনের জমানো বৃষ্টি। তার অবিরত বর্ষণে সুন্দর মুখটা এক চিলতে নদীর মতো দেখাচ্ছে। চোখ ফিরিয়ে সামনে দিকে হাঁটতে লাগলাম। কেন যেন আমার চোখে বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে।
লজিং মাস্টার
সোহানুর রহমান অনন্ত
লজিং থাকাটা অনেকটা ঘরজামাইয়ের মতো। মুখবুজে সবকিছু সহ্য করতে হয়। আমার কথা শুনে মুখ টিপে হাসল পল্লবী। হাসলে ওর গালে টোল পড়ে, বড় টোল। হাসছ কেন? হাসির কিছু বলেছি। নাহ্ বলেননি, এমনি হাসলাম। এক কাপ চা দিয়ে গেল মুকুলের মা। চায়ের ধোঁয়া উঠছে কুণ্ডলী পাকিয়ে, সেই ধোঁয়া ঝাপসা করে দেয় সুন্দর মুখটাকে। পাশে বসে অঙ্ক করছে টুনি। ক্লাস ফাইভে পড়ে, পল্লবী এবার কলেজে উঠেছে। বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করে, আলাদা হয়ে গেছে বছর দুয়েক আগে। মাঝে মধ্যে আসে। ইচ্ছে হলে হাতখরচ দেয়, না হলে দেয় না। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পল্লবীর মা খেটে মরে। মুখ দিয়ে তবু একবারের জন্যও স্বামীর নামে অভিশাপ দেয় না। এখানেই বোধহয় স্ত্রী হওয়া সার্থকতা। এমন ভালো মানুষটিকে নিয়ে কেন সংসার করল না, তা আমার বোধগম্য নয়। এমন একটা সংসারে লজিং থাকাও লজ্জার ব্যাপার। কিন্তু উপায় নেই, ভালো একটা চাকরি না পেয়ে কোথাও যাচ্ছি না। স্যার আপনি কি বিকেলে ফ্রি আছেন? পল্লবীর কথায় নিজেকে ফিরে পেলাম। আছি কেন বল তো? আমার সঙ্গে একটু যেতে হবে, কি যাবেন না? কোথায়? গেলেই দেখতে পাবেন। ঠিক আছে যাব। আবার টোল পড়া ঘালের হাসি চোখ ঝাপসা করে দিল।
২.
রিকশা স্টেশন রোড ধরে চলছে। আমরা যাচ্ছি কোথায় সেটাই তো বললে না? কোথাও যাচ্ছি না, আপনাকে নিয়ে রিকশায় ঘুরতে ইচ্ছে হলো, এমনি বললে তো আর আসতেন না। মানে কি? মানে-টানে কিছু নেই, ঘুরতে ইচ্ছে হলো ঘুরছি। তাই বলে আমাকে বলবে না? না বলব না, বলিনি তো কী হয়েছে। হুটহাট রেগে যায় পল্লবী, এখনও মনে হয় রেগে গেছে। আমি কিছুই বললাম না, রাগী মেয়েদের বেশি রাগাতে নেই। বেশি রেগে গেলে জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। এই তোমার রিকশা ঘুরিয়ে আগের জায়গা নিয়ে যাও। বুঝলাম বড্ড বেশি রেগে গেছে। রিকশাওয়ালা কী বুঝল জানি না, সে আবার ঘুরিয়ে ফেলল। বাড়ির সামনে আসতেই রিকশা থেকে নেমে সোজা বাড়ির ভেতর চলে গেল পল্লবী। আমি হাঁটতে হাঁটতে বড় রাস্তার দিকে গেলাম। লাইব্রেরিতে একটু ঢুঁ মারব। কিছুক্ষণ আগে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো মনের পর্দায় ভেসে উঠছে। যখন বাসায় ফিরলাম ততক্ষণে সন্ধ্যা নেমে গেছে। টিপটিপ বৃষ্টি ঝরছিল, এখন বড় বড় ফোঁটা আকারে পড়তে শুরু করেছে। বাসায় ফিরতেই শুনি পল্লবী সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে মাথা ফাটিয়ে ফেলেছে। অদ্ভুত ব্যাপার, এটা আবার কখন ঘটল। টুনি আর কিছুই বলল না, পল্লবীর ঘরে চলে গেল। শব্দ করে একটা কাঁশি দিয়ে ঘরে ঢুকলাম। পল্লবীর মাথায় ব্যান্ডেজ, আমাকে দেখে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল। পল্লবীর মা কি কিচেনে চলে গেল। সেই সুযোগে জিজ্ঞেস করলাম, এত পাগলী কেন তুমি। কোনো উত্তর নেই। আচ্ছা এখানে রাগ করার মতো কী হয়েছে? তারপরও কোনো উত্তর নেই। আমি চলে আসব এমন সময় বলল, আমি আপনার ওপর রাগ করিনি। আমার মনটা এমনিতেই ভালো নেই। বিশ্বাস হচ্ছে না। সত্যি, এই দেখুন আমি হাসছি। টোল পড়া হাসিমাখা একটা মুখ আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আর আমি মার্বেলের মূর্তির মতো তাকিয়ে রইলাম।
৩.
পল্লবীকে ভালোবাসি কি-না জানি না। তবে ওর কথা ভাবতে ভালোলাগে। মাঝে মধ্যে জ্যোৎস্নামাখা রাত দেখতে ইচ্ছে করে। হাতে হাত রেখে রেললাইনের পথ ধরে বহুদূর হেঁটে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু কেন যেন একটা দেয়াল অনুভব করি। পল্লবীর মা আমাকে অগাত বিশ্বাস করে, আর পল্লবীও তো আমাকে কোনো গ্রিন সিগনাল দেয়নি। সুতরাং একতরফা ভালোবাসার কোনো মানে হয় না। দিনগুলো যেন খাঁচায় বন্দিপাখির মতোই কাটতে লাগল আমার। সকাল-বিকেল পল্লবীর হাসি আমার স্নায়ুতে আগুন ধরিয়ে দেয়। নিজেকে আড়াল করা ছাড়া আর কোনো উপায় নেই আমার। বিশ্বাসে আগুন দেওয়া পাপ, তাই নিজ থেকেই সরে যেতে চাইছিলাম। এরই মধ্যে এক বিকেলে পিয়ন এসে একটা চিঠি ধরিয়ে দিল। আমার চাকরি হয়ে গেছে। টুনি খুশিতে একটা লাফ দিয়ে বলল, ভাই মিষ্টি খাওয়াবেন না? আমি হেসে বললাম খাওয়াব।
কাশি দিয়ে আবার ঘরে ঢুকলাম। টুনি এতক্ষণে ঢোল পিটিয়ে সব বলে দিয়েছে। তারপরও আমি বললাম, একটা চাকরি হয়ে গেছে আমার। কয়েকদিন পরই চলে যাব এ বাড়ি ছেড়ে। পল্লবীর মা অনুরোধের সুরে বলল, পল্লবীর বিয়ের সময় ডাকলে আসতে হবে কিন্তু। আমি নীরবে মাথা নাড়িয়ে বলেছি আসব, অবশ্যই আসব। পল্লবী কিছুই বলেনি, ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে মাথা নিচু করে। সামনের চুলগুলো বাতাসে এদিক-সেদিক নড়াচড়া করছে। টুনি বলল, স্যার আমার বিয়ের সময়ও কিন্তু আসতে হবে। ওর কথা শুনে সবাই হেসেছিল, হাসেনি কেবল পল্লবী। ওর মুখে অন্য কিছু ফুটে উঠেছে, যা পড়তে পাড়ি কিন্তু পড়ব না। পড়লে বিপদ আরও বেড়ে যাবে। ব্যাগ কাঁধে যখন নেমে পড়ি, তখন পল্লবীকে দেখতে পাইনি। টুনির চোখে জল, পল্লবীর মায়ের চোখেও জল। এতটা দিন তাদের বাসায় লজিং ছিলাম, আমাকে কোনোদিন পরের ছেলের মতো দেখেননি তিনি। তাই বোধকরি কষ্ট হচ্ছিল।
রাস্তায় হলদে বাতির নিচে দাঁড়িয়ে একবার ফিরে তাকিয়েছিলাম বাড়িটির দিকে। পল্লবী দাঁড়িয়ে ছিল বারান্দার শিক ধরে। ওর চোখ ভরতি বৃষ্টি, অনেকদিনের জমানো বৃষ্টি। তার অবিরত বর্ষণে সুন্দর মুখটা এক চিলতে নদীর মতো দেখাচ্ছে। চোখ ফিরিয়ে সামনে দিকে হাঁটতে লাগলাম। কেন যেন আমার চোখে বৃষ্টি নামতে শুরু করেছে।
No comments:
Post a Comment