join facebook page

Monday, 1 June 2015

২৯ মে ২০১৫,শুক্রবার- দিগন্ত সাহিত্য-patay>>><<<special thanks #Jobayer_Raju_ke

ঝড়

সোহানুর রহমান

স্টেশন রোডের বনলতা ক্যাফের সামনে আসতেই ঝুপঝুপ বৃষ্টি শুরু হলো। বাইকটা রেখে একটি কনফেকশনারিতে দাঁড়ালাম। শিলাবৃষ্টি, সেই সাথে আকাশে মেঘের গুড়–ম গুড়–ম শব্দ। সিগ্ধ বিকেলটা কখন যে মেঘের আড়ালে হারিয়ে গেছে বলা মুশকিল। ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি ৪টা বেজে কুড়ি। বাসায় যাওয়া জরুরি। অথচ ঝড়, বড় বড় শিলাবৃষ্টি, সেই সাথে হাড়কাঁপানো বাতাস। হাত বাড়িয়ে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির স্পর্শ নিই। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ভিজতে, মনের দেয়াল ভেজাতে। বৃষ্টি একটু ধরে এলো। আর কিছুক্ষণ পরই সন্ধ্যা নেমে যাবে। সুতরাং ৩৩৬ নাম্বার বাড়িটির সামনে পানি জমার আগেই যেতে হবে আমাকে। বাইক স্টার্ট করে ছুটলাম। কিছুদূর যেতেই আবার ঝুপঝুপ বৃষ্টি শুরু হলো। এবার আর কোথাও আশ্রয় নিলাম না। বৃষ্টির কাছে নিজেকে সঁপে দিলাম। মন্দ লাগছিল না ভিজতে। ল্যাম্পপোস্টের আলোয় ৩৩৬ নম্বর বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম। ভাগ্যভালো ততটা পানি এখনো জমেনি রাস্তায়। সিঁড়ি বেয়ে উঠে পড়লাম পাঁচতলায়। ঘরের মধ্যে ঢুকতেই লোডশেডিং। তোয়ালে দিয়ে মাথা মোছার সময় অনুভব করলাম শরীরটা কেমন গরম হয়ে আসছে। জ্বর আসবে নাতো? দূর! কত বৃষ্টিতে ভিজেছি আমি, কখনো তো সেইভাবে জ্বরটর আসেনি। কিছুক্ষণের মধ্যে মাথাটা কেমন ভারী হয়ে গেল, শীতল একটি অনুভূতি হতে লাগল। আমার ধারণা ভুল প্রমাণ করে তাপিয়ে জ্বর এলো। কত তা না মেপে বলা মুশকিল। নতুন বাড়িতে উঠেছি সবে, বদলি চাকরিটাও নতুন। এখনো মাইনে পাইনি, তাই ঘরের জিনিসপত্রও কেনা হয়নি। ভাঙা চকিটাতে শুয়ে পড়লাম একটি চিকন কাঁথা গায়ে দিয়ে। জ্বর যে ক্রমে বেড়েই চলছে টের পাচ্ছি। একসময় মনে হলো জ্বরে বোধহয় মরেই যান। ৮টা নাগাদ বৃষ্টি থেমে গেল। অন্ধকার একটি ঘরে পড়ে রইলাম আমি। অমাবস্যার অন্ধকার যেন আরো অন্ধকারে দিয়েছে আমাকে।
জ্বরে আমার সারা শরীর পুড়ে যাচ্ছে। কিন্তু একটি জিনিস ভেবে আমি খুব অবাক হচ্ছি। ভাঙা চকিতে আমি খুব আরামে শুয়ে আছি। আমার মাথার নিচে কে যেন একটি নরম বালিশ গুঁজে দিয়েছে। চিকন কাঁথার বদলে একটি মোটা কম্বল দিয়ে আমার সারা শরীর ঢাকা। এমন সময় খেয়াল হলো অমাবস্যার রাতে কী করে জানি ঘরটা চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠল! ঘরজুড়ে মিষ্টি একটা গন্ধ। ঠিক সেই মুহূর্তে একটি শীতল হাত, কে যেন আমার কপালের ওপর রাখল। বুঝলাম আমার কপালে জলপট্টি দেয়া হচ্ছে। কিন্তু কে দিচ্ছে? এই শহরে তো আমার আপন বলতে কেউ নেই। তা ছাড়া ঢাকার ফ্যাটগুলো তো আরো অদ্ভুত। কেউ কারো খবর নেয় না। তাহলে আমার মাথার কাছে বসে আছে কে? বুঝতে পারছিলাম এটা কোনো নারীর হাত। ঠিক সেই মুহূর্তে মনে হলো গলাটা কেমন শুকিয়ে গেছে, এক গ্লাস পানি যদি পান করা যেত। এমনটা যখন ভাবছি, আমার মাথার কাছে বসে থাকা মেয়েটি উঠে দাঁড়াল। ঝাপসা চোখে আমি দেখলাম খানিক বাদেই মেয়েটি আমার সামনে এসে দাঁড়াল। পানির গ্লাস এগিয়ে দিলো। অদ্ভুত, আমি মেয়েটির মুখ দেখতে পাচ্ছি না। মাথাটা একটু তুলে ঢকঢক করে গিলে ফেললাম। ঠিক সেই মুহূর্তে একটি কণ্ঠ আমার কান্তি দূর করে দিলো। মেয়েটি বলল, আমাকে চিন্তে পেরেছ? চেহারায় চিন্তে না পারলেও কণ্ঠটা আমার চেনা, অনেক দিনের চেনা। মেয়েটি আবার বলল, চিন্তে পারোনি, তাই না। আমি আলতো করে বললাম, কে, নীলা? হ্যাঁ, আমি তোমার নীলা। নীলা... এতদিন পর কোত্থেকে? নীলার কোনো জবাব নেই। আজ থেকে তিন বছর আগে নীলাকে বিয়ে করেছিলাম ভালোবেসে। ছোট্ট সুখের সংসার ছিল আমার। অভাব ছিল বটে, কিন্তু সুখ ছিল। সবই ঠিক ছিল। তারপরও কোথায় যেন একটা অঙ্ক ভুল হয়ে গেল। একদিন অফিস থেকে ফিরে দেখি, নীলা বাসায় নেই। ছোট্ট একটি চিরকুট চোখে পড়ল। তাতে লেখা, আমাকে খোঁজার বৃথা চেষ্টা করে লাভ নেই। আমি তোমার জীবন থেকে চলে যাচ্ছি। শুধু ভালোবাসা দিলেই হয় না, ভালোবাসা ছাড়াও নারীর অনেক চাওয়া-পাওয়া থাকে। তোমার সামান্য রোজগারে তো পেট চালানোই দায়। চিরকুট শেষ হওয়ার আগেই চোখ দিয়ে বৃষ্টি ঝরেছিল। কালচৈত্রের বৃষ্টি।
নীলার কণ্ঠ ভারী হয়ে এসেছে, আমি তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি।
ক্ষমা...?।
হ্যাঁ, ক্ষমা। তোমাকে কষ্ট দিয়ে আমি সুখী হতে চেয়েছিলাম, কিন্তু জানো, সুখী তো আমি হতেই পারিনি; বরং দুঃখের চোরাবালিতে আটকে গেছি।
তোমার ক্ষমা চাইতে হবে না। তোমার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই।
সত্যি বলছো তুমি?
হ্যাঁ সত্যি, হাজারবার সত্যি।
যাক এবার আমি শান্তি পাবো।
শরীরটা এখন একটু ভালো লাগছে। ছলছল চোখে নীলা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখের কোণ বেয়ে জল ঝরে পড়ছে মাঝে মাঝে। তুমি কাঁদছো কেন? পাগলি মেয়ে কোথাকার। সত্যি, তোমার প্রতি আমার কোনো রাগ নেই। তুমি অনেক বড় মনের একজন মানুষ, আমি অকৃতজ্ঞ। না হলে তোমাকে ছেড়ে অন্য কারো হাত ধরে চলে যেতে পারতাম না।
আমি কিছুই বলতে পারলাম না। পুরনো ভালোবাসা আবার যেন নতুন করে মরুভূমির বুকে আছড়ে পড়েছে। হঠাৎই চোখটা ঝাপসা হয়ে এলো। নীলার সুন্দর মুখটা আস্তে আস্তে ঝাপসা হয়ে আসছে। খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, নীলার দিকে তাকিয়ে থাকতে। কিন্তু চোখ দুটো মেলতেই পারছিলাম না। কখন যে অচেতন হয়েছি নিজেও জানি না।
বাইরে প্রচণ্ড ঝড়, চোখ দুটো মেলতেই নীলা... নীলা বলে বেশ কয়েকবার ডাকলাম। কোনো সাড়াশব্দ নেই। আমার শরীরে একফোঁটা জ্বর নেই। বালিশের কাছেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিউলি ফুল চোখে পড়ল। নীলার খুব পছন্দের ফুল শিউলি। পুরো ঘর তন্ন তন্ন করে খুঁজলাম, কোথাও নীলা নেই। হঠাৎ যেন আমি স্বজ্ঞানে ফিরে এলাম। নীলা তো আমার নতুন বাড়ির ঠিকানা জানে না, আসবে কী করে! আর দরজাও তো ভেতর থেকে লাগানো। সবকিছুই কেমন এলোমেলো মনে হতে লাগল। কিছুই মেলাতে পারছি না। বৃষ্টি একটু কমে এলে, বাইক নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। নিউ মার্কেটে নীলার চাচাতো ভাইয়ের দোকান আছে। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, নীলা কেমন আছে? আমার কথা শুনে ভদ্রলোক বললেন, আপনি কিছুই জানেন না!
কী জানব।
আরে নীলা তো গত সপ্তাহ দুয়েক আগে মারা গেছে। ডেলিভারি কেস, বাঁচানো গেল না। শুনে যেন মার্বেলের মূর্তি হয়ে গেলাম

No comments:

Post a Comment