join facebook page

Monday, 22 September 2014

চাঁদপুর, শনিবার ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৪, ২৯


অপরাধী
সোহানুর রহমান অনন্ত
মানুষের জীবনে কখন এসে দুর্দিন দেখা দেয় তা কেউ বলতে পারে না, বলতে পারেনি আদম আলীও। তার জীবনে আজ দুর্দিন ভয়াবহ দুর্দিন যাচ্ছে। অথচ কিছুদিন আগেও তার গোলাভরা ধান ছিলো, উঠোন জুড়ে ছিলো হাস-মুরগির বিচরণ, গোয়াল ভরা গরু, পুকুর জুড়ে ছিলো বড় বড় মাছের ছোটাছুটি ছিলো। কিন্তু আজ নেই কিছুই নেই আদম আলীর। সর্বনাশা পদ্মার ভাঙ্গনে তার জীবন থেকে সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। চোখের সামনেই বাপ-দাদার ভিটা মাটি ফসলের মাঠ এক এক করে হারিয়ে গেলো পদ্মার গহীন অথৈ জলে। সবকিছু হারিয়ে নিঃশ্ব হয়ে ঢাকার শহরে পারি জমায় আদম আলী। সঙ্গে তার স্ত্রী এবং দু' মেয়ে ১০ বছরের মণি ও ৭ বছরের মুক্তা। প্রথমে ঢাকায় এসে কাজের জন্য দিশেহারা হয়ে যায় আদম আলী। পরে অনেক কষ্টে ইসলামপুর একটা মার্কেটে লেবারের কাজ পায়। দিনে যা রোজগার হতো কোনো রকম দু মেয়ে আর স্ত্রীকে নিয়ে দু' মুঠো ডাল-ভাত খেয়ে চলে যেতো কদম আলীর। এক সময় খুব আরামের বিছানায় শুয়ে দিন কেটেছিলো আদম আলীর স্ত্রী কিন্তু আজ ঠাঁই হয়েছে কমলাপুর বস্তিতে। মাঝে মাঝে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আদম আলীর বউ পড়শীদের কাছে বলে কে ভেবে ছিলো আল্লাহ্ আমাদের কপালে এমন কষ্ট লেইখা রাখছে। মেয়ে দুটো সারাক্ষণ রেল লাইনের রাস্তার পাশে বসে খেলা করে, আর অপেক্ষায় থাকে কহন সন্ধ্যা হইবো আর বাপজান আইবো। কদম আলীর কোনদিন রোজগার একটু বেশি হয়, কোনদিন আবার কম হয়, যেদিন বেশি হয় সেদিন ছোট মেয়েটা মুক্তার জন্য পাকা কলা নিয়ে যায়। ছোট থেইকাই মুক্তা পাকা কলার পাগল, আর বড় মেয়ে মণি ওর কোনো ইচ্ছা নেই। কম বেশি মণি সংসারের সব কিছুই বুঝতে শিখেছে। বাপের অবস্থা ভালো করেই উপলব্ধি করছে মণি তাই ওর কোনো বায়না নেই। এভাবেই আদম আলীর সংসার এক রকম দুঃখে কষ্টে চলে যাচ্ছিলো। একদিন সন্ধ্যা বেলা গম্ভীর মুখে বাসায় ফিরে আদম আলী। এসে দেখে ছোট মেয়েটার ভীষণ জ্বর, পাশে বসে ওর মা মাথায় জল পট্টি দিচ্ছে। কহন থেইকা ওর জ্বর? প্রশ্ন করে আদম আলী। দুপুরের পর থেইকা জ্বর আইছে, আপনের মুখটা এতো শুকনা কেন? কোনো খারাপ সংবাদ। না, মানে কাইল থেইকা দুই দিন হরতাল, হরতালে দিয়াতো আর মার্কেট খুলবোনা আর মার্কেট না খুললো টেকা পয়সাও কামাইতে পারুম না। এর মধ্যে আবার মাইয়াডার জ্বর আইছে অহন যে আমি কি করি। অতো চিন্তা কইরেন না আল্লাহ একটা না একটা ব্যবস্থা কইরাই দিবো। মণি কই? আছে হয়তো রানুগো ঘরে বইসা রানুর লগে কথা কইতাছে। আপনে কয়ডা ভাত খাইয়া ঘুমানতো সারাদিন অনেক খাইট্টা আইছেন। হু, দাও দেহি কয়ডা ডাইল ভাত।

মাঝ রাতে হঠাৎ রানুর বাপ এসে আদম আলীরে ডেকে বললো কাইল থেইকা দুইদিন তো হরতাল, এইর মধ্যে তো কাজ কর্ম নাই চলো আমরা মিছিলে যাই হাজিরা দুইশো টাকা। আদম আলী মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলে না মিয়া মিছিল মিটিংয়ের ধারে কাছে যামু না। চিন্তা কইরা দেখো আদম দুই দিনে চাইরশো টেকা পাইবা না খেয়ে মরার চেয়ে তিন চাইর ঘণ্টা মিছিল কইরা যদি চাইরশো টেকা পাও তাতে মন্দ কি? আদম আলী কি করবে ভেবে পাচ্ছে না। ঘরে আদরের মেয়ে মুক্তার জ্বর, চাল-ডালও নাই, ঘরে বসে থাকার চেয়ে মিছিলে গেলে মনে হয় ভালা অইবো, আমরা গরিবেরা কাজ না করলে তো আসলেই না খাইয়া মরুম। আদম আলী পাকা কথা দিয়ে দেয় রানুর বাপকে কাল সে মিছিলে যাচ্ছে। পরদিন আদম আলী মিছিলে যায়, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার মাঝে প্রথম দিন হরতাল শেষ হয়। সন্ধ্যা বেলা মেয়ের জন্য ঔষধ নিয়ে আসে আদম আলী। মুক্তার অবস্থা এখন আগের চাইতে একটু ভালো। আদম আলীকে আসতে দেখেই মাথা তুলে মুক্তা বলে আমার জন্য কলা আনছো বাপজান? হু মা আনছি কলা আনছি আম আনছি। কি মজা মণি আপার লাইগা কিছু আনে নাই সব আমার লাইগা আনছ এই বলে মুক্তা বিছানা থেকে মাথা তুলে হাসে। মণি ঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিলো, আদম আলী সেদিকে তাকিয়ে বলে তোর লাইগা কাইল কিছু আনুম নে মন খারাপ করিস্ না মা। আব্বা এই মিছিলে তোমার না গেলে অয় না? কি মারামারি হয় আমার ডর করে। ডর কিরে মা ঘরে বইসা থাকলে তোগোরে খাওয়াইবো কে? নে চাল আনছি ভাত রান্না কর ক্ষিধা লাগছে।

পরের দিন আবার হরতালে গেলো আদম আলী, আসার সময় মুক্তাকে বলে এসেছে আজ আবার ওর জন্য পাকা কলা নিয়ে যাবে। এ কথা শুনে খুব খুশি হয়েছিলো মুক্তা। আজকের হরতাল খুব ভয়াবহ চলছে, চারিদিকে গাড়ি ভাংচুর, পুলিশের সাথে সংঘর্ষ, ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া চলছে। মিছিলের ঝাঁঝালো আওয়াজে তোলপাড় হয়ে যাচ্ছে রাস্তাঘাট। হঠাৎ হরতালে পক্ষ বিপক্ষের মধ্যে মারামারি লেগে গেলো। দু চারটা বোমা ফুটলো, মানুষ দিগি�দিক ছুটতে লাগলো, কদম আলী কিছু বুঝে ওঠার আগেই কয়েকটা যুবক এসে মারতে শুরু করলো। পুলিশ চেয়ে চেয়ে দেখলো সেই দৃশ্য পুলিশের দায়িত্বের কোনো ভূমিকা পালন করলো না। আদম আলী ছেলেগুলোর পা ধরে বলতে লাগলো বাবা গো আমারে ছাইড়া দাও পেটের জ্বালায় রাস্তায় নামছি, আমি গরির মানুষ সন্ত্রাসী না। ঘরে আমার অসুস্থ মেয়ে আমার পথ চেয়ে আছে, এ বলে আবার পুলিশের পায়ে গিয়া ধরলো। ভাইরা আমারে বাঁচান ওরা আমারে মাইরা ফালাইলো। পুলিশ কিছুই করলো না ওল্টো আরো আদম আলীর শার্ট টেনে ধরে ওদের হাতে তুলে দিলো। আদম কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলতো লাগলো আমারে আর মাইরোনা মইরা যামু আর শয্য হইতাছে না। কিন্তু কে শুনে কার কথা নরপশুরা লাঠি দিয়ে পিটিয়ে রক্তাত করেই শান্ত� হয়নি। রাস্তার মধ্যে ফেলে মোটা লোহার শেকল দিয়ে মাথার মধ্যে কয়েক বার আঘাত করে ফেলে যায় আদম আলীকে। আদম আলীর রক্তে লাল হয়ে যায় রাস্তার ধুলো মাটিগুলো। আদম আলী চোখের সামনে আপছা আপছা আঁধার দেখতে পায়, ভেসে উঠে বড় মেয়েটির মুখ। (বাপজান তুমি মিছিলে যাইওনা আমার কেমন জানি ডর করে) সেই কচি সুর কানে বেজে উঠে। ছোট্ট মেয়েটির সেই মুখ ভারা হাসি, (বাপজান আমার লাইগা পাকা কলা আইনো, তাইলে আমার জ্বর ভালা অইয়া যাইবো) তারপর আস্তে আস্তে হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসে আদম আলীর। নিভে যাচ্ছে জীবন প্রদীপ নিভে যাচ্ছে, হাজার হাজার লোক ছুটে যাচ্ছে আদম আলীর ওপর দিয়ে, কেউবা হাতে কেউবা মুখের ওপর পায়ের চাপা দিয়ে। আদম আলী চিৎকার করে ওদের বললো আমারে তোমরা একটু বাঁচাও....বাঁচাও...কেউ শুনলোনা সেই ডাক। এক সময় চারিদিকের কোলাহলের মাঝে থেমে গেলো আদম আলীর চিৎকার। নিভে গেলো আদম আলীর জীবন প্রদীপ, সেই দৃশ্য দেখে আকাশটা বুঝি কষ্ট পেয়েছিলো, কষ্ট পেয়েছিলো মেঘেরা। তাইতো আদম আলীকে একটু ছুঁয়ে দেখার জন্য বৃষ্টি হয়ে নেমে এলো বৃষ্টির দল। বাতাস থেমে গিয়েছিলো কিছুক্ষণের জন্য, গোটা পৃথিবী নিঃশব্দে কেঁদেছিলো কিছুক্ষণের জন্য। এই মৃত্যুর জন্য দায়ী কে, ক্ষুধার যন্ত্রণায় কেউ পথে বসে মরে কেউবা চেয়ে চেয়ে দেখে সেই দৃশ্য। তাই মনে আজ প্রশ্ন জাগে, আর কতদিন এভাবে পথে পথে নীরিহ গরির মানুষদের প্রাণ হারাতে হবে, দেশের এই অবস্থার জন্য কে অপরাধী। সন্ধ্যা পেরিয়ে রাত নেমে এলো তবুও আদম আলী ফিরলো না ঘরে, ছোট্ট মেয়েটি বাবার অপেক্ষায় বসে আছে, কখন বাপজান আসবে পাকা কলা নিয়ে। কিন্তু কে তাকে বলবে তার বাবা যে আর কোনোদিনও ফিরবে না........কোনোদিনও না।

No comments:

Post a Comment