চাঁদপুর, শনিবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৪, ৫ আশ্বিন(pathok forum)
সোনালী স্বপ্ন
সোনালী স্বপ্ন
সোহানুর রহমান অনন্ত
সারাদিন
পথে পথে কাগজ কুড়ায় মন্টু। ক্ষুধা পেলে রাস্তার পাশের টিউবওয়েল থেকে পানি
খায়। রাতের বেলা রাস্তার পাশে ছালা বিছিয়ে ঘুমায় মাথার নিচে শক্ত ইট দিয়ে।
মন্টুর সাথে ওর বয়সী আরো অনেক টোকাই আছে এখানে। কিন্তু মন্টু ওদের সাথে
মেশে না। ওরা নেশা করে, নেশা খুব খারাপ কাম এটা মন্টু জানে। মন্টু এ লাইনে
একেবারে নতুন। আগে একটা হোটেলে কাজ করতো, কয়েক দিন আগে সেখান থেকে পালিয়ে
এসেছে। হোটেলের মালিক লোকটা বেশি একটা সুবিধার ছিলো না। মন্টুকে খুব খাটাতো
বিনিময়ে দিতো বাসি খাবার। সেদিন হাত থেকে পড়ে একটা গ্লাস ভেঙে গিয়েছিলো
তাই লোকটা মন্টুকে খুব মারধর করে। সেদিন রাতেই মন্টু পলিয়ে আসে।
আজ বেশি একটা কাগজ কুড়াতে পারেনি মন্টু। বৃষ্টি হয়েছিলো, তাই এ অবস্থা। রাতের বেলা রাস্তার পাশে বসে গাড়ির আসা যাওয়া দেখছে। পেটে টান টান ক্ষুধার উত্তেজনা। এমন সময় সেখানে কয়েকটা ছেলে এসে দাঁড়ালো।
মন্টুর সামনে দাঁড়িয়ে একটি ছেলে বললো, এই লাইনে নতুন?
ছেলেটির দিকে তাকালো মন্টু। মুখের মধ্যে খোঁচা খোঁচা দাড়ি আছে। গালের মধ্যে সেলাইয়ের দাগ।
মন্টু মাথা নিচু করে বললো জ্বি নতুন এসেছি।
নাম কি? পাশে থাকা একটি ছেলে প্রশ্ন করে।
মন্টু।
আগে কী করতা?
হোটেলে চাকুরি করতাম।
আমগোরে চেনো?
জ্বে না।
কি হালায় আমগোরে চেনে না, ছেলেগুলো হাসাহাসি করতে লাগলো। মাঝখানে থাকা ছেলেটা বললো এই যে, এই এলাকায় আছত, এইটা আমাগো এলাকা বুঝলি। এখানে থাকতে হলে আমগোরে চান্দা দিয়া থাকতে হয় বুঝলি। এখন ক� তো পকেটে কতো টেকা আছে।
মন্টু ঘাবড়ে গেলো, তোতলাতে তোতলাতে বললো, না আমার কাছে কোন টাকা নেই। মাঝখানের ছেলেটা বললো, তোরা দু�জন দেখতো ওর পকেটে কি আছে? হুকুম নাযিল হতেই ছেলে দু�টি মন্টুকে টেনে তুললো বসা থেকে। তারপর পকেট থেকে বের করে আনলো বিশ টাকার একটি নোট। মন্টু ওদের সাথে টানাটানি করতে গিয়ে নিজের ছেড়া শার্টটা আরো ছিড়ে ফেলে। টাকা নিয়েই ছেলেগুলো সেখান থেকে পালিয়ে যায়।
মন্টুর দু�চোখ দিয়ে জল ঝড়তে থাকে। কত কষ্ট করেই না টাকাটা জমিয়েছিলো। কিন্তু পাষাণ ছেলেগুলো অসহায় ওর কাছ থেকে তা কেড়ে নিল। মন্টু জানে না ওর বাবা কে? কি-বা ওর পরিচয়। কোথায় বাড়ি, কোথায় ঘর এসব ও কিছুই জানে না। ছোট থেকেই মানুষের ধিক্কার খেয়ে এতটুকু বয়স পর্যন্ত এসেছে। কেউ আজ পর্যন্ত ওকে আপন করে নেয়নি। কেউ ওর বন্ধুও হয়নি কোনদিন। শুধু এ পথ আর রাস্তার পাশে ল্যাম্প লাইটগুলো ছাড়া। মন্টুর কাছে যখন বেশ একা একা লাগে ল্যাম্প লাইটের সাথে কথা বলে। উত্তরের আশায় নয় বরং নিজের কষ্টগুলো বলে যাওয়ার আশায়। মন্টু নামটি ওর কে রেখেছে সেটাও জানে না। শুধু জানে মন্টু এ পৃথিবীতে বড় একা। আর মানুষ যখন বড় একলা হয়ে যায় তখন সে অসহায় ও ঘৃণার পাত্র হয়ে বেঁচে থাকে এ পৃথিবীর বুকে।
পরদিন ঠিক একি অবস্থা হলো। সারদিন কাগজ কুড়িয়ে এসে মন্টু যখন রাস্তার পাশে দাঁড়ালো। ছেলেগুলো এসে জোর করে ওর টাকাট নিয়ে গেলো। আজও মন্টু কিছু বলতে পারলো না। এভাবেই তিন চারদিন টাকা নেয়ার পর মন্টু ভাবলো সে এখানে আর থাকবে না। এখানের ছেলেগুলা একটুও ভালা না। তাই সে পরদিন সেখান থেকে চলে গেলো। এরি মধ্যে দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। পাক হানাদার বাহিনী, ঝাপিয়ে পড়ছে বাঙালি মানুষদের ওপর। চারিদিকে মানুষের করুণ আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠলো। জায়গা-জমি, ঘর-বাড়ি রেখে সবাই পালাতে লাগলো একটু নিরপদ আশ্রয়ের খোঁজে।
বাঙালি বীর মুক্তিযোদ্ধারা দেশের ডাকে সাড়া দিয়ে ঝাপিয়ে পড়লো এ দেশের মাটি রক্ষা করার জন্য। মন্টু খুব ছোট, যুদ্ধ করার মতো বয়স ওর হয়নি। কিন্তু ও যুদ্ধে যেতে চায়। জন্মের পর থেকে কেউ ওরে আপন করে নেয়নি কেবল এ মাটি ছাড়া। আজ এ মাটিকে রক্ষা করতে নিজের প্রাণটি পর্যন্ত দিতে রাজি মন্টু।
সেখান ছেড়ে অনিক অনেক দূরে চলে এলো। নতুন জায়গায়। চারিদিকে গাছ-গাছালি ভরা। আঁকা-বাঁকা কাঁচা রাস্তা, গ্রাম্য পরিবেশ। এখানে এসে বাজারের রাস্তা পরিষ্কার করার কাজ পায় মন্টু। ঘুমায় রাস্তার পাশে।
একদিন মাঝ রাতে মন্টু ঘুমিয়ে আছে রাস্তার পাশে। হঠাৎ কিছুর শব্দ পেয়ে মন্টু ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলতেই মন্টু দেখে, কালো চাদর মুড়ি দেয়া কয়েকজন লোক এদিকে আসছে। মন্টু প্রথমে পাকবাহিনী ভেবে ভয় পেয়ে যায়। শোয়া থেকে উঠে বসে। লোকগুলো কাছে আসতেই মন্টু ভয়ে কাঁপতে লাগলো। শেষে লোকগুলো মন্টুর অবস্থা দেখে বললো, ভয় পেয়ে না ছোট ভাই আমরা পাক হানাদার নই, আমরা মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধার কথা শুনতেই সাহসে মন্টুর বুকটা ভরে উঠে। পাশে থাকা একজন মুক্তিযোদ্ধা বললো, রাস্তার পাশে তুমি কি করো? মিলিটারি ঘুরতাছে, তোমার ডর করে না? মন্টু মাথা উঁচু করে বললো আমার কোনো ঘর-বাড়ি নাই। এ রাস্তাই আমার ঘর-বাড়ি। আর ডর ভয় তো ওল্টা আমারে ডরায়। লোকগুলো অবাক হয়ে যায় মন্টুর কথা শুনে।
একজন মুক্তিযোদ্ধার হাতে ধরে মন্টু বললো, আমারে আপনেগো সাথে নেবেন। আমি দেশের জন্য যুদ্ধ করতে চাই। মুক্তিযোদ্ধারা অবাক হয়ে যায় এতুটুকু ছেলের কথা শুনে। তারপর একজন বললো, দেখ তুমি এখনো অনেক ছোট। তুমিতো যুদ্ধ করতে পারবে না। কথাটা শুনে মন্টুর মুখ কালো হয়ে গেলো। তাৎক্ষণিক আবার বললো, আইচ্ছা আমি কি আপনাগো কোনো উপকার করতে পারুম না?
এমনিতে তুমি কি করো?
আমি কাগজ কুড়াই, বাজারের রাস্তা ঝাড়� দেই।
তাইলো তুমি আমগো অস্ত্রগুলান এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে বা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছাইয়া দিতে পারো। তুমি কাগজ কুড়াও তাই তোমারে মিলিটারিরা সন্দেহ করবো না। মন্টু রাজি হয়ে গেলো ওদের কথায়। মুক্তিযোদ্ধারা মন্টুকে ক্যাম্পে নিয়ে গেল।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান লিটন ভাই মন্টুর সাহস এবং মনোবল দেখে খুব খুশি হলেন। তিনি মন্টুকে খুব পছন্দ করলেন। পরদিন থেকেই দেশের জন্য ওর কাজ শুরু হয়ে গেলো। জীবন বাজি রেখে নিজের কাগজের ব্যাগে গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতে লাগলো।
একদিন মন্টু কাগজের ব্যাগ নিয়ে এক মুক্তিযোদ্ধার ক্যাম্পে যাচ্ছিলো, হঠাৎ করে পাকহানাদার বাহিনীর সামনে পড়ে গেলো।
ওর দিকে পিস্তল তাক করে কয়েকজন এগিয়ে এলো। সাথে ছিলো একজন অফিসার এবং কয়েকজন লোক। হাত-পা বাধা বাঙালি। মন্টু ভয়ে থর থর করে কাঁপতে লাগলো। মন্টুর সামনেই বাঙালিদের নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। মন্টু ভয়ে অফিসারের পায় জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আর বললো স্যার হ্যামি টোকাই মানুষ। হ্যামারে মাইরেন না। মন্টুর কান্না দেখে অফিসারের দয়া হলো, তাই সে মন্টুকে না মেরে কাছে ডেকে নিলেন।
তু টোকাই হে?
জ্বি স্যার
আচ্ছা, তু তো জানতাহে ইদার মে মুক্তি কাহা হে?
হা স্যার
কাহা?
মন্টু আঙুল দিয়ে ভুল পথের দিকে দেখিয়ে দিলো।
অফিসার খুশি হয়ে বললো, যা মে তুজ কো ছোড় দে তা হু, যাহ্।
নতুন জীবন পেয়ে মন্টু ছুটে গেলো পাখির মতো এবং মুক্তিযোদ্ধাদের খবরটা জানালো যে পাকসেনাদের ওল্টো রাস্তা দেখিয়ে এসেছে। ঠিক তখনি মুক্তিযোদ্ধারা সেই রাস্তায় গিয়ে ফাঁদ পেতে রইলো। পাক সেনারা আসতেই শুরু করলো গুলি। ব্যাস সব মরে সাফ।
এভাবেই মন্টু একের পর খবর দিতে লাগলো মিলিটারীদের সম্পর্ক। আর ছালার বস্তায় করে গোলাবারুদ, মেশিনগান মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতে লাগলো। যুদ্ধ চলতে লাগলো।
মন্টু একদিন রাতে স্বপ্ন দেখলো দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। লাল-সবুজ পতাকা সবাই বিজয়ের গান গাইছে। মুক্ত পাখিরা আকাশে উড়ছে, রক্ত স্রোত বন্ধ হয়ে গেছে। সেই সোনালী স্বপ্ন মন্টু মুক্তিযোদ্ধার প্রধান লিটন ভাইকে বললো। লিটন ভাই হেসে বললো তোমার স্বপ্ন সত্যি হবে মন্টু।
সেদিন মন্টু কাশবনের পাশ দিয়ে ফিরছিলো। পাক-বাহিনীর সম্পর্কে একটা জরুরি খবর দিতে হবে লিটন ভাইকে। এমন সময় দেখে কয়েকজন লোক এদিকে আসছে। লোকগুলো মন্টুর কাছে আসতেই মন্টু ওদের চিনতে পারলো। আকবর ভাই আর করিম ভাই। ওরা দু�জন ক্যাম্পের পাশে থাকে। আকবর ভাই কাছে এসে বললো মন্টু তোমাকে লিটন ভাই এখনি যেতে বলেছে। মন্টু বলল আমিতো লিটন ভাইয়ের কাছেই যাচ্ছি, চল আমরা ক্যাম্পে যাই। লিটন ভাই ক্যাম্পে নেই মন্টু ওনি একটা গোপন জায়গায় আছে। কোথায়? চল তোমায় নিয়ে যাচ্ছি। মন্টু ওদের পেছনে হাঁটতে লাগলো। লোকগুলো মন্টুকে কিছু দূর হরিপুরের কাছের একটা স্কুলের ভেতর নিয়ে গেলো। কোনো মুক্তিকেই মন্টু দেখতে পেলো না। তাই মন্টুর কেমন যেন ভয় করছে। লোকগুলোর মতলব ঠিক ভালো নয়। একটু পরেই মন্টু আসল সত্যটা জেনে গেলো। আসলে ও যাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা ভেবেছে আসলে ওরা রাজাকার। এ দেশের শুত্রু। মন্টুকে ওরা পাকহানাদের হাতে তুলে দিলো। মন্টু বুঝতে পারছিলো যে ওর আর বাঁচা হবে না। তাই মরার আগে দেশের জন্য একটা ভালো কাজ করে যেতে চায়। স্কুলটির ভেতরে বেশ কয়েকজন রাজাকার ছিলো। রাজাকাররা মন্টুর অবস্থা দেখে হাসতে লাগলো। আর পাকিস্তান জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ বলতে লাগলো। মন্টু ওদের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো, এ দেশ তোদের নয়, এ দেশের মাটিও তোদের নয়, তোগো এ দেশের বুকে বেঁচে থাকার কোনো হক নেই। ছালার বস্তা থেকে বোমা বের করে মন্টু ফাটিয়ে দিলো। আর সাথে সাথে স্কুলটির ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটলো। রাজাকারদের হাসি থেমে গেলো। পাকহানাদারদের ক্যাম্প ধ্বংস হয়ে গেলো। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে মন্টু পাকহানাদের শেষ করে গেলো। এদিকে লিটন ভাই মন্টুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো কিন্তু মন্টু আর ফিরে এলো না। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলো। কালো মেঘের ফাঁকে উঁকি দিলো একটি স্বাধীন সূর্য। চারিদিকে লাল-সবুজের পতাকা হাতে সবাই বিজয়ের গান গাইতে লাগলো। মন্টুর স্বপ্ন সত্যি হলো। মন্টুর মতো এমন লাখো লাখো বাঙালির রক্তের উপর ভর করে দাঁড়ালো আরেকটি দেশ। বাংলাদেশ।
আজ বেশি একটা কাগজ কুড়াতে পারেনি মন্টু। বৃষ্টি হয়েছিলো, তাই এ অবস্থা। রাতের বেলা রাস্তার পাশে বসে গাড়ির আসা যাওয়া দেখছে। পেটে টান টান ক্ষুধার উত্তেজনা। এমন সময় সেখানে কয়েকটা ছেলে এসে দাঁড়ালো।
মন্টুর সামনে দাঁড়িয়ে একটি ছেলে বললো, এই লাইনে নতুন?
ছেলেটির দিকে তাকালো মন্টু। মুখের মধ্যে খোঁচা খোঁচা দাড়ি আছে। গালের মধ্যে সেলাইয়ের দাগ।
মন্টু মাথা নিচু করে বললো জ্বি নতুন এসেছি।
নাম কি? পাশে থাকা একটি ছেলে প্রশ্ন করে।
মন্টু।
আগে কী করতা?
হোটেলে চাকুরি করতাম।
আমগোরে চেনো?
জ্বে না।
কি হালায় আমগোরে চেনে না, ছেলেগুলো হাসাহাসি করতে লাগলো। মাঝখানে থাকা ছেলেটা বললো এই যে, এই এলাকায় আছত, এইটা আমাগো এলাকা বুঝলি। এখানে থাকতে হলে আমগোরে চান্দা দিয়া থাকতে হয় বুঝলি। এখন ক� তো পকেটে কতো টেকা আছে।
মন্টু ঘাবড়ে গেলো, তোতলাতে তোতলাতে বললো, না আমার কাছে কোন টাকা নেই। মাঝখানের ছেলেটা বললো, তোরা দু�জন দেখতো ওর পকেটে কি আছে? হুকুম নাযিল হতেই ছেলে দু�টি মন্টুকে টেনে তুললো বসা থেকে। তারপর পকেট থেকে বের করে আনলো বিশ টাকার একটি নোট। মন্টু ওদের সাথে টানাটানি করতে গিয়ে নিজের ছেড়া শার্টটা আরো ছিড়ে ফেলে। টাকা নিয়েই ছেলেগুলো সেখান থেকে পালিয়ে যায়।
মন্টুর দু�চোখ দিয়ে জল ঝড়তে থাকে। কত কষ্ট করেই না টাকাটা জমিয়েছিলো। কিন্তু পাষাণ ছেলেগুলো অসহায় ওর কাছ থেকে তা কেড়ে নিল। মন্টু জানে না ওর বাবা কে? কি-বা ওর পরিচয়। কোথায় বাড়ি, কোথায় ঘর এসব ও কিছুই জানে না। ছোট থেকেই মানুষের ধিক্কার খেয়ে এতটুকু বয়স পর্যন্ত এসেছে। কেউ আজ পর্যন্ত ওকে আপন করে নেয়নি। কেউ ওর বন্ধুও হয়নি কোনদিন। শুধু এ পথ আর রাস্তার পাশে ল্যাম্প লাইটগুলো ছাড়া। মন্টুর কাছে যখন বেশ একা একা লাগে ল্যাম্প লাইটের সাথে কথা বলে। উত্তরের আশায় নয় বরং নিজের কষ্টগুলো বলে যাওয়ার আশায়। মন্টু নামটি ওর কে রেখেছে সেটাও জানে না। শুধু জানে মন্টু এ পৃথিবীতে বড় একা। আর মানুষ যখন বড় একলা হয়ে যায় তখন সে অসহায় ও ঘৃণার পাত্র হয়ে বেঁচে থাকে এ পৃথিবীর বুকে।
পরদিন ঠিক একি অবস্থা হলো। সারদিন কাগজ কুড়িয়ে এসে মন্টু যখন রাস্তার পাশে দাঁড়ালো। ছেলেগুলো এসে জোর করে ওর টাকাট নিয়ে গেলো। আজও মন্টু কিছু বলতে পারলো না। এভাবেই তিন চারদিন টাকা নেয়ার পর মন্টু ভাবলো সে এখানে আর থাকবে না। এখানের ছেলেগুলা একটুও ভালা না। তাই সে পরদিন সেখান থেকে চলে গেলো। এরি মধ্যে দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। পাক হানাদার বাহিনী, ঝাপিয়ে পড়ছে বাঙালি মানুষদের ওপর। চারিদিকে মানুষের করুণ আহাজারিতে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠলো। জায়গা-জমি, ঘর-বাড়ি রেখে সবাই পালাতে লাগলো একটু নিরপদ আশ্রয়ের খোঁজে।
বাঙালি বীর মুক্তিযোদ্ধারা দেশের ডাকে সাড়া দিয়ে ঝাপিয়ে পড়লো এ দেশের মাটি রক্ষা করার জন্য। মন্টু খুব ছোট, যুদ্ধ করার মতো বয়স ওর হয়নি। কিন্তু ও যুদ্ধে যেতে চায়। জন্মের পর থেকে কেউ ওরে আপন করে নেয়নি কেবল এ মাটি ছাড়া। আজ এ মাটিকে রক্ষা করতে নিজের প্রাণটি পর্যন্ত দিতে রাজি মন্টু।
সেখান ছেড়ে অনিক অনেক দূরে চলে এলো। নতুন জায়গায়। চারিদিকে গাছ-গাছালি ভরা। আঁকা-বাঁকা কাঁচা রাস্তা, গ্রাম্য পরিবেশ। এখানে এসে বাজারের রাস্তা পরিষ্কার করার কাজ পায় মন্টু। ঘুমায় রাস্তার পাশে।
একদিন মাঝ রাতে মন্টু ঘুমিয়ে আছে রাস্তার পাশে। হঠাৎ কিছুর শব্দ পেয়ে মন্টু ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলতেই মন্টু দেখে, কালো চাদর মুড়ি দেয়া কয়েকজন লোক এদিকে আসছে। মন্টু প্রথমে পাকবাহিনী ভেবে ভয় পেয়ে যায়। শোয়া থেকে উঠে বসে। লোকগুলো কাছে আসতেই মন্টু ভয়ে কাঁপতে লাগলো। শেষে লোকগুলো মন্টুর অবস্থা দেখে বললো, ভয় পেয়ে না ছোট ভাই আমরা পাক হানাদার নই, আমরা মুক্তিযোদ্ধা। মুক্তিযোদ্ধার কথা শুনতেই সাহসে মন্টুর বুকটা ভরে উঠে। পাশে থাকা একজন মুক্তিযোদ্ধা বললো, রাস্তার পাশে তুমি কি করো? মিলিটারি ঘুরতাছে, তোমার ডর করে না? মন্টু মাথা উঁচু করে বললো আমার কোনো ঘর-বাড়ি নাই। এ রাস্তাই আমার ঘর-বাড়ি। আর ডর ভয় তো ওল্টা আমারে ডরায়। লোকগুলো অবাক হয়ে যায় মন্টুর কথা শুনে।
একজন মুক্তিযোদ্ধার হাতে ধরে মন্টু বললো, আমারে আপনেগো সাথে নেবেন। আমি দেশের জন্য যুদ্ধ করতে চাই। মুক্তিযোদ্ধারা অবাক হয়ে যায় এতুটুকু ছেলের কথা শুনে। তারপর একজন বললো, দেখ তুমি এখনো অনেক ছোট। তুমিতো যুদ্ধ করতে পারবে না। কথাটা শুনে মন্টুর মুখ কালো হয়ে গেলো। তাৎক্ষণিক আবার বললো, আইচ্ছা আমি কি আপনাগো কোনো উপকার করতে পারুম না?
এমনিতে তুমি কি করো?
আমি কাগজ কুড়াই, বাজারের রাস্তা ঝাড়� দেই।
তাইলো তুমি আমগো অস্ত্রগুলান এক ক্যাম্প থেকে অন্য ক্যাম্পে বা মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছাইয়া দিতে পারো। তুমি কাগজ কুড়াও তাই তোমারে মিলিটারিরা সন্দেহ করবো না। মন্টু রাজি হয়ে গেলো ওদের কথায়। মুক্তিযোদ্ধারা মন্টুকে ক্যাম্পে নিয়ে গেল।
মুক্তিযোদ্ধাদের প্রধান লিটন ভাই মন্টুর সাহস এবং মনোবল দেখে খুব খুশি হলেন। তিনি মন্টুকে খুব পছন্দ করলেন। পরদিন থেকেই দেশের জন্য ওর কাজ শুরু হয়ে গেলো। জীবন বাজি রেখে নিজের কাগজের ব্যাগে গোলাবারুদ মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতে লাগলো।
একদিন মন্টু কাগজের ব্যাগ নিয়ে এক মুক্তিযোদ্ধার ক্যাম্পে যাচ্ছিলো, হঠাৎ করে পাকহানাদার বাহিনীর সামনে পড়ে গেলো।
ওর দিকে পিস্তল তাক করে কয়েকজন এগিয়ে এলো। সাথে ছিলো একজন অফিসার এবং কয়েকজন লোক। হাত-পা বাধা বাঙালি। মন্টু ভয়ে থর থর করে কাঁপতে লাগলো। মন্টুর সামনেই বাঙালিদের নির্মমভাবে হত্যা করা হলো। মন্টু ভয়ে অফিসারের পায় জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলো। আর বললো স্যার হ্যামি টোকাই মানুষ। হ্যামারে মাইরেন না। মন্টুর কান্না দেখে অফিসারের দয়া হলো, তাই সে মন্টুকে না মেরে কাছে ডেকে নিলেন।
তু টোকাই হে?
জ্বি স্যার
আচ্ছা, তু তো জানতাহে ইদার মে মুক্তি কাহা হে?
হা স্যার
কাহা?
মন্টু আঙুল দিয়ে ভুল পথের দিকে দেখিয়ে দিলো।
অফিসার খুশি হয়ে বললো, যা মে তুজ কো ছোড় দে তা হু, যাহ্।
নতুন জীবন পেয়ে মন্টু ছুটে গেলো পাখির মতো এবং মুক্তিযোদ্ধাদের খবরটা জানালো যে পাকসেনাদের ওল্টো রাস্তা দেখিয়ে এসেছে। ঠিক তখনি মুক্তিযোদ্ধারা সেই রাস্তায় গিয়ে ফাঁদ পেতে রইলো। পাক সেনারা আসতেই শুরু করলো গুলি। ব্যাস সব মরে সাফ।
এভাবেই মন্টু একের পর খবর দিতে লাগলো মিলিটারীদের সম্পর্ক। আর ছালার বস্তায় করে গোলাবারুদ, মেশিনগান মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দিতে লাগলো। যুদ্ধ চলতে লাগলো।
মন্টু একদিন রাতে স্বপ্ন দেখলো দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। লাল-সবুজ পতাকা সবাই বিজয়ের গান গাইছে। মুক্ত পাখিরা আকাশে উড়ছে, রক্ত স্রোত বন্ধ হয়ে গেছে। সেই সোনালী স্বপ্ন মন্টু মুক্তিযোদ্ধার প্রধান লিটন ভাইকে বললো। লিটন ভাই হেসে বললো তোমার স্বপ্ন সত্যি হবে মন্টু।
সেদিন মন্টু কাশবনের পাশ দিয়ে ফিরছিলো। পাক-বাহিনীর সম্পর্কে একটা জরুরি খবর দিতে হবে লিটন ভাইকে। এমন সময় দেখে কয়েকজন লোক এদিকে আসছে। লোকগুলো মন্টুর কাছে আসতেই মন্টু ওদের চিনতে পারলো। আকবর ভাই আর করিম ভাই। ওরা দু�জন ক্যাম্পের পাশে থাকে। আকবর ভাই কাছে এসে বললো মন্টু তোমাকে লিটন ভাই এখনি যেতে বলেছে। মন্টু বলল আমিতো লিটন ভাইয়ের কাছেই যাচ্ছি, চল আমরা ক্যাম্পে যাই। লিটন ভাই ক্যাম্পে নেই মন্টু ওনি একটা গোপন জায়গায় আছে। কোথায়? চল তোমায় নিয়ে যাচ্ছি। মন্টু ওদের পেছনে হাঁটতে লাগলো। লোকগুলো মন্টুকে কিছু দূর হরিপুরের কাছের একটা স্কুলের ভেতর নিয়ে গেলো। কোনো মুক্তিকেই মন্টু দেখতে পেলো না। তাই মন্টুর কেমন যেন ভয় করছে। লোকগুলোর মতলব ঠিক ভালো নয়। একটু পরেই মন্টু আসল সত্যটা জেনে গেলো। আসলে ও যাদেরকে মুক্তিযোদ্ধা ভেবেছে আসলে ওরা রাজাকার। এ দেশের শুত্রু। মন্টুকে ওরা পাকহানাদের হাতে তুলে দিলো। মন্টু বুঝতে পারছিলো যে ওর আর বাঁচা হবে না। তাই মরার আগে দেশের জন্য একটা ভালো কাজ করে যেতে চায়। স্কুলটির ভেতরে বেশ কয়েকজন রাজাকার ছিলো। রাজাকাররা মন্টুর অবস্থা দেখে হাসতে লাগলো। আর পাকিস্তান জিন্দাবাদ জিন্দাবাদ বলতে লাগলো। মন্টু ওদের দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলো, এ দেশ তোদের নয়, এ দেশের মাটিও তোদের নয়, তোগো এ দেশের বুকে বেঁচে থাকার কোনো হক নেই। ছালার বস্তা থেকে বোমা বের করে মন্টু ফাটিয়ে দিলো। আর সাথে সাথে স্কুলটির ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটলো। রাজাকারদের হাসি থেমে গেলো। পাকহানাদারদের ক্যাম্প ধ্বংস হয়ে গেলো। বুকের তাজা রক্ত দিয়ে মন্টু পাকহানাদের শেষ করে গেলো। এদিকে লিটন ভাই মন্টুর জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো কিন্তু মন্টু আর ফিরে এলো না। দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধের পর দেশ স্বাধীন হলো। কালো মেঘের ফাঁকে উঁকি দিলো একটি স্বাধীন সূর্য। চারিদিকে লাল-সবুজের পতাকা হাতে সবাই বিজয়ের গান গাইতে লাগলো। মন্টুর স্বপ্ন সত্যি হলো। মন্টুর মতো এমন লাখো লাখো বাঙালির রক্তের উপর ভর করে দাঁড়ালো আরেকটি দেশ। বাংলাদেশ।
No comments:
Post a Comment