শনিবার, ২০ জুন ২০১৫
পড়ন্ত বিকেলের ভালোবাসা
সোহানুর রহমান অনন্ত
অল্প করে হলেও নায়লাকে আমার ভালোলাগে। রোজ বিকেলে স্টেশন রোডে ওর কারণেই বসে থাকি। এক নজর দেখব বলে, আজো বসে আছি। প্রাইভেট শেষ করে এই পথেই ফিরবে নায়লা। একা নয় সঙ্গে আর দুজন থাকবে, একটি ছেলে এবং আরেকজন মেয়ে। সঙ্গের মেয়েটি কথা বেশি বলে, হাঁটার গতির চেয়ে কথার কথা গতি বেশি।
মাঝখানে নায়লা চুপ করে শুনে যায়। কথার খই ফুটে না, কিন্তু ওর দিকে তাকালে আমার মনের ভেতর ভালোবাসার ফুল ফুটে অকারণে। দুপুর থেকেই মেঘলা আকাশ। বেশ রোমান্টিক একটা বিকেল বলতেই হবে। দূর থেকে নায়লাকে দেখে উঠে দাঁড়ালাম। প্রতিদিনই এভাবে দাঁড়িয়ে যাই। পেছনের পকেটে একটি ফুল, টকটকে লাল গোলাপ ফুল। নায়লা খুব কাছাকাছি চলে আসে এবং পাশ কাটিয়ে চলে যায়। ভুল করে একবার তাকায় আমার দিকে।
আমার চোখ তখন এক জোড়া পৃথিবীর মতো নায়লাকে নিয়ে হারিয়ে যেতে চায়। নায়লা চলে যায়, পেছনের পকেট থেকে গোলাপটা বের করে ওর উদ্দেশে রেখে দেই রেল লাইনের ওপর। খাণিক বাদেই ট্রেন এসে ক্ষতবিক্ষত করে দেয় গোলাপটাকে। আমি তাকিয়ে থাকি আর ভাবি, এই একটা জায়গা স্রষ্টা গভীর থেকে গভীরতম দুর্বলতা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে আমায়। কেন যেন নায়লার চোখে চোখ রেখে ভালোবাসার কথাটা বলতে পারি না। আর পারি না বলেই বিন্দু থেকে সিন্দুতে পরিণত হচ্ছে সেই ভালোবাসাটুকু।
২.
অনেকটা বেলা করে ঘুম থেকে উঠলাম। মা কখন এক কাপ রেখে গেছে তা বলা মুশকিল। উঠে দেখি চায়ের কাপটা আস্ত বরফের টুকরের মতো ঠাণ্ডা হয়ে আছে। ফ্রেশ হয়ে বের হতে যাব এমন সময় মা বলল, সকালে বাবা এসেছিল। কেন এসেছিল জানতে চাইলে মা বলল, টাকা চাইতে। কিসের টাকা। মা ফুফিয়ে কেঁদে উঠে। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলে, জানি না। আমার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করার পর থেকে সম্পর্কে অবনতি ঘটে।
শুনেছি আজকাল পাকা জুয়াড়ি হয়ে উঠেছেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়লাম। শিক্ষিত বেকারদের মানুষে তিন নম্বর চোখে দেখে। তিন নম্বর চোখ মানে মনের চোখ অর্থাৎ খারাপ-ভালোর মাঝামাঝি। চায়ের দোকানে বসলে অনেকের চায়ের অফার করে। কিন্তু টিউশনির সময় চলে যায় বলে আর আড্ডা দেয়া হয় না জমিয়ে। যে বাড়িতে আমি টিউশনি করি তার তিন বাড়ি পার হলেই নায়লাদের বাড়ি। মাঝে মাঝে পা টিপে যাওয়া হয়, ছাদের এক কোণে নায়লা দাঁড়িয়ে থাকে। মুখের ওপর পড়ন্ত রোদের আল্পনা, আমাকে শিহরিত করে। আর এগুতে পারি না, পা আটকে আসে। আজো আকাশ মেঘলা, তবে গতকালকের মতো নয়। একটু বেশি, বেশি মানে অনেক বেশি। বিকেলই রাজ্যের অন্ধকার নেমে এসেছে স্টেশনের আশপাশে। আমি বসে আছি, পেছনের পকেটে গোলাপ, টকটকে লাল গোলাপ।
৩.
অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরও নায়লার মুখ দেখতে পেলাম না। অকারণে বৃষ্টির কবলে পড়লাম। বাইকটা স্টার্ট করতেই বৃষ্টির সঙ্গে আরেকটা শব্দ যোগ হলো। গটগটগট….গট। চৌরাস্তার দিকে ছুটলাম, মায়ের জন্য ওষুধ নিতে হবে। বৃষ্টিতে এসে আবার থেমে গেলো, টিএনটি স্কুলের সামনে বাবার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। ল্যাম্পের আলোর নিচে বসে আছে। বাইকটা থামিয়ে বাবার সামনে গিয়ে বসলাম, আমাকে দেখে লজ্জিত কণ্ঠে বলল, তোর কাছে বিশটা টাকা হবে। কেন প্রশ্ন করার আগেই পকেট থেকে টাকাটা দিয়ে দিলাম। টাকাটা দিয়ে আমি জিজ্ঞেস করার আগেই বাবা বলল, আজ জুয়া খেলতে গিয়ে তোর মায়ের দেয়া আংটিটা হেরে গেছি। বাবার চোখের কোণে এক টুকরো বৃষ্টি দেখতে পেলাম।
আমার কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে বাবা উঠে দাঁড়ালেন। বার কয়েক বাড়িতে যাওয়ার কথা বললাম, কিন্তু তিনি যেতে রাজি নন। পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে টানতে টানতে চলে গেলেন ধোঁয়া উঠা ট্রেনের মতো। বুকের বাম পাশটায় খুব ব্যথা অনুভব করতে লাগলাম। বাইক নিয়ে আবার চললাম চৌরাস্তার দিকে।
৪.
বৃষ্টি আবার শুরু হয়েছে। ওষুধ নিয়ে একটি কনফেকশনারির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। একটা রিকশা এসে থামলে তারপর একটি মেয়ে দ্রুত এসে ঢুকলো কনফেকশনারিতে। এক মুহ‚র্তের জন্য আমার রক্ত চলাচল যেন বন্ধ হয়ে গেল।
নায়লা এখানে। আমাকে দেখে মার্বেলের মূর্তি হয়ে গেল নায়লা। আমি প্রশ্ন ছুড়ে দেয়ার আগেই বলল, আমার এক বান্ধবীর বার্থডেতে গিয়েছিলাম। তারপর বৃষ্টির কবলে পড়লাম, কাল আবার পরীক্ষা তাই আসতেই হলো। দেখুন তো রিকশা আর সামনে যাবে না, বড্ড বিপদে পড়ে গেছি। অভিমান আর হাসি মিশ্রিত কথাগুলো যেন তীরের মতো গেঁথে যাচ্ছিল আমার মনের দেয়ালে। বুঝতে পারলাম আজ কেন দেখিনি স্টেশন রোডে। হেসে বললাম, আপনার সমস্যা না থাকলে আমার সঙ্গে বাইক আছে, আপনাকে পৌঁছে দিতে পারি। কয়েক সেকেন্ড ভেবে মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলো নায়লা। আরো এক ঘণ্টা অপেক্ষা করেও বৃষ্টির থামার কোনো নামগন্ধ পেলাম না। বাধ্য হয়ে বৃষ্টির মধ্যেই রওনা হলাম। যে মানুষটিকে নিয়ে এতদিন কল্পনা করেছি, বাস্তবে সে আমার পাশেই। অন্ধকার আর বৃষ্টি তার বুক চিরে আমার বাইক ছুটে চলছে। অদ্ভুত সুন্দর একটা পারফিউমের ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম নায়লার শরীর থেকে। নায়লার বুকের ধুকধুক শব্দটা যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। সাহস করে বলতে চাইছিলাম কথাটা…ভালোবাসি বড্ড বেশি ভালোবাসি তোমায়।
৫.
এই রাস্তাটায় অনেক কাদা জমে আছে তাই চাইলেও জোরে চালাতে পারছি না। ঠিক সেই মুহ‚র্তে নায়লা ফিসফিস করে বলল, আপনাকে একটা কথা বলব?। শিউর বলুন। আপনি রোজ আমাকে দেখার জন্য দাঁড়িয়ে থাকেন না আমার বান্ধবীকে?।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, তোমাকে। জানতাম। কিভাবে? মেয়েরা ছেলেদের মনের কথা বুঝতে পারে, সৃষ্টির আদি থেকে স্রষ্টা মেয়েদের মাঝে এই ক্ষমতাটা দিয়ে দিয়েছে। তাই। হু। তাহলে নিশ্চয় জানো কেন দাঁড়িয়ে থাকি?। হ্যাঁ জানি, কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। আমার বুকের বাম পাশটা ছলাৎ করে উঠল। কেন সম্ভব নয়?। নায়লা চুপ করে রইল। জাস্ট এতটুকু বলল, আপনি আর স্টেশন রোডে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। কারণ আপনাকে আমার ভালো লাগে না। আর কিছু বলার শক্তি পেলাম না। বৃষ্টির জলের সঙ্গে কখন যে চোখের জল মিশে গেছে বুঝতে পারিনি। নায়লাও আর কোনো কথা বলল না। ওর যা বলার বলে দিয়েছে। নায়লার বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে ফিরে আসার সময় নায়লা বলল, এক কাপ চা তো খেয়ে যান। ইচ্ছে হচ্ছিল না তবুও গেলাম, নায়লার মা সব শুনে ধন্যবাদ দিলেন। চা খেয়ে আর দেরি করলাম না।
বের হওয়ার সময় দেখলাম বারান্দা দিয়ে নায়লা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টির মধ্যে বাইক নিয়ে ছুটে চললাম। এরপর অনেক দিন স্টেশন রোডে যায়নি। কেন যেন খুব খারাপ লাগছিল। একা একা থাকতে চাইছলাম। জানালা দিয়ে একলা আকাশ দেখতাম। হঠাৎ একদিন একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এলো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মিষ্টি রিনরিনে গলায় বলল, আমি নায়লা। অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। আপনি আজ বিকেলে স্টেশন রোডে আসবেন। কেন? বলেছি আসবেন, কি আসবেন না?। আসব। অনেক ধন্যবাদ, ফোনটা রেখে দিল আমাকে আশ্চর্য করে।
৬.
পড়ন্ত বিকেলে একলা দাঁড়িয়ে আছি স্টেশন রোডে দাঁড়িয়ে আছি। কিছুক্ষণ পর একটা রিরশা এসে থামলে কিছুদূর। নায়লা এসেছে, হালকা লালচে রঙের একটা শাড়ি পরে। কপালে বড় একটা টিপ। আমার কাছে এসে বলল, হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছেন কেন চলুন। কোথায়? আজ রেললাইনের পথ ধরে অনেক দূর হেঁটে যাব। মানে?। মানে বুঝতে হবে না। এই বলে নায়লা আমার হাতটা ধরল। তারপর বলল, আমার গোলাপ কোথায়।
আমি হেসে বললাম, সেদিনের পর থেকে আর গোলাপ কিনিনি। বাট আমি কিনেছি, এই বলে নায়লা একটা গোলাপ আমার হাতে দিয়ে বলল, আসলেই তুমি একটা বোকা। আমি না বলেছি বলে আর দাঁড়াবে না, কত কষ্ট হয়েছে তোমাকে না দেখতে পেরে। পড়ন্ত বিকেলে রোদটা আবার এসে পড়েছে নায়লার মুখের ওপর। আর আমার বুকের ভেতর নীরব শিহরণ।
পড়ন্ত বিকেলের ভালোবাসা
সোহানুর রহমান অনন্ত
অল্প করে হলেও নায়লাকে আমার ভালোলাগে। রোজ বিকেলে স্টেশন রোডে ওর কারণেই বসে থাকি। এক নজর দেখব বলে, আজো বসে আছি। প্রাইভেট শেষ করে এই পথেই ফিরবে নায়লা। একা নয় সঙ্গে আর দুজন থাকবে, একটি ছেলে এবং আরেকজন মেয়ে। সঙ্গের মেয়েটি কথা বেশি বলে, হাঁটার গতির চেয়ে কথার কথা গতি বেশি।
মাঝখানে নায়লা চুপ করে শুনে যায়। কথার খই ফুটে না, কিন্তু ওর দিকে তাকালে আমার মনের ভেতর ভালোবাসার ফুল ফুটে অকারণে। দুপুর থেকেই মেঘলা আকাশ। বেশ রোমান্টিক একটা বিকেল বলতেই হবে। দূর থেকে নায়লাকে দেখে উঠে দাঁড়ালাম। প্রতিদিনই এভাবে দাঁড়িয়ে যাই। পেছনের পকেটে একটি ফুল, টকটকে লাল গোলাপ ফুল। নায়লা খুব কাছাকাছি চলে আসে এবং পাশ কাটিয়ে চলে যায়। ভুল করে একবার তাকায় আমার দিকে।
আমার চোখ তখন এক জোড়া পৃথিবীর মতো নায়লাকে নিয়ে হারিয়ে যেতে চায়। নায়লা চলে যায়, পেছনের পকেট থেকে গোলাপটা বের করে ওর উদ্দেশে রেখে দেই রেল লাইনের ওপর। খাণিক বাদেই ট্রেন এসে ক্ষতবিক্ষত করে দেয় গোলাপটাকে। আমি তাকিয়ে থাকি আর ভাবি, এই একটা জায়গা স্রষ্টা গভীর থেকে গভীরতম দুর্বলতা দিয়ে পৃথিবীতে পাঠিয়েছে আমায়। কেন যেন নায়লার চোখে চোখ রেখে ভালোবাসার কথাটা বলতে পারি না। আর পারি না বলেই বিন্দু থেকে সিন্দুতে পরিণত হচ্ছে সেই ভালোবাসাটুকু।
২.
অনেকটা বেলা করে ঘুম থেকে উঠলাম। মা কখন এক কাপ রেখে গেছে তা বলা মুশকিল। উঠে দেখি চায়ের কাপটা আস্ত বরফের টুকরের মতো ঠাণ্ডা হয়ে আছে। ফ্রেশ হয়ে বের হতে যাব এমন সময় মা বলল, সকালে বাবা এসেছিল। কেন এসেছিল জানতে চাইলে মা বলল, টাকা চাইতে। কিসের টাকা। মা ফুফিয়ে কেঁদে উঠে। তারপর শান্ত কণ্ঠে বলে, জানি না। আমার বাবা দ্বিতীয় বিয়ে করার পর থেকে সম্পর্কে অবনতি ঘটে।
শুনেছি আজকাল পাকা জুয়াড়ি হয়ে উঠেছেন। একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাইরে বেরিয়ে পড়লাম। শিক্ষিত বেকারদের মানুষে তিন নম্বর চোখে দেখে। তিন নম্বর চোখ মানে মনের চোখ অর্থাৎ খারাপ-ভালোর মাঝামাঝি। চায়ের দোকানে বসলে অনেকের চায়ের অফার করে। কিন্তু টিউশনির সময় চলে যায় বলে আর আড্ডা দেয়া হয় না জমিয়ে। যে বাড়িতে আমি টিউশনি করি তার তিন বাড়ি পার হলেই নায়লাদের বাড়ি। মাঝে মাঝে পা টিপে যাওয়া হয়, ছাদের এক কোণে নায়লা দাঁড়িয়ে থাকে। মুখের ওপর পড়ন্ত রোদের আল্পনা, আমাকে শিহরিত করে। আর এগুতে পারি না, পা আটকে আসে। আজো আকাশ মেঘলা, তবে গতকালকের মতো নয়। একটু বেশি, বেশি মানে অনেক বেশি। বিকেলই রাজ্যের অন্ধকার নেমে এসেছে স্টেশনের আশপাশে। আমি বসে আছি, পেছনের পকেটে গোলাপ, টকটকে লাল গোলাপ।
৩.
অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরও নায়লার মুখ দেখতে পেলাম না। অকারণে বৃষ্টির কবলে পড়লাম। বাইকটা স্টার্ট করতেই বৃষ্টির সঙ্গে আরেকটা শব্দ যোগ হলো। গটগটগট….গট। চৌরাস্তার দিকে ছুটলাম, মায়ের জন্য ওষুধ নিতে হবে। বৃষ্টিতে এসে আবার থেমে গেলো, টিএনটি স্কুলের সামনে বাবার সঙ্গে দেখা হয়ে গেলো। ল্যাম্পের আলোর নিচে বসে আছে। বাইকটা থামিয়ে বাবার সামনে গিয়ে বসলাম, আমাকে দেখে লজ্জিত কণ্ঠে বলল, তোর কাছে বিশটা টাকা হবে। কেন প্রশ্ন করার আগেই পকেট থেকে টাকাটা দিয়ে দিলাম। টাকাটা দিয়ে আমি জিজ্ঞেস করার আগেই বাবা বলল, আজ জুয়া খেলতে গিয়ে তোর মায়ের দেয়া আংটিটা হেরে গেছি। বাবার চোখের কোণে এক টুকরো বৃষ্টি দেখতে পেলাম।
আমার কাছ থেকে টাকাটা নিয়ে বাবা উঠে দাঁড়ালেন। বার কয়েক বাড়িতে যাওয়ার কথা বললাম, কিন্তু তিনি যেতে রাজি নন। পকেট থেকে একটা সিগারেট বের করে টানতে টানতে চলে গেলেন ধোঁয়া উঠা ট্রেনের মতো। বুকের বাম পাশটায় খুব ব্যথা অনুভব করতে লাগলাম। বাইক নিয়ে আবার চললাম চৌরাস্তার দিকে।
৪.
বৃষ্টি আবার শুরু হয়েছে। ওষুধ নিয়ে একটি কনফেকশনারির সামনে দাঁড়িয়ে আছি। একটা রিকশা এসে থামলে তারপর একটি মেয়ে দ্রুত এসে ঢুকলো কনফেকশনারিতে। এক মুহ‚র্তের জন্য আমার রক্ত চলাচল যেন বন্ধ হয়ে গেল।
নায়লা এখানে। আমাকে দেখে মার্বেলের মূর্তি হয়ে গেল নায়লা। আমি প্রশ্ন ছুড়ে দেয়ার আগেই বলল, আমার এক বান্ধবীর বার্থডেতে গিয়েছিলাম। তারপর বৃষ্টির কবলে পড়লাম, কাল আবার পরীক্ষা তাই আসতেই হলো। দেখুন তো রিকশা আর সামনে যাবে না, বড্ড বিপদে পড়ে গেছি। অভিমান আর হাসি মিশ্রিত কথাগুলো যেন তীরের মতো গেঁথে যাচ্ছিল আমার মনের দেয়ালে। বুঝতে পারলাম আজ কেন দেখিনি স্টেশন রোডে। হেসে বললাম, আপনার সমস্যা না থাকলে আমার সঙ্গে বাইক আছে, আপনাকে পৌঁছে দিতে পারি। কয়েক সেকেন্ড ভেবে মাথা ঝাঁকিয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দিলো নায়লা। আরো এক ঘণ্টা অপেক্ষা করেও বৃষ্টির থামার কোনো নামগন্ধ পেলাম না। বাধ্য হয়ে বৃষ্টির মধ্যেই রওনা হলাম। যে মানুষটিকে নিয়ে এতদিন কল্পনা করেছি, বাস্তবে সে আমার পাশেই। অন্ধকার আর বৃষ্টি তার বুক চিরে আমার বাইক ছুটে চলছে। অদ্ভুত সুন্দর একটা পারফিউমের ঘ্রাণ পাচ্ছিলাম নায়লার শরীর থেকে। নায়লার বুকের ধুকধুক শব্দটা যেন স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলাম। সাহস করে বলতে চাইছিলাম কথাটা…ভালোবাসি বড্ড বেশি ভালোবাসি তোমায়।
৫.
এই রাস্তাটায় অনেক কাদা জমে আছে তাই চাইলেও জোরে চালাতে পারছি না। ঠিক সেই মুহ‚র্তে নায়লা ফিসফিস করে বলল, আপনাকে একটা কথা বলব?। শিউর বলুন। আপনি রোজ আমাকে দেখার জন্য দাঁড়িয়ে থাকেন না আমার বান্ধবীকে?।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, তোমাকে। জানতাম। কিভাবে? মেয়েরা ছেলেদের মনের কথা বুঝতে পারে, সৃষ্টির আদি থেকে স্রষ্টা মেয়েদের মাঝে এই ক্ষমতাটা দিয়ে দিয়েছে। তাই। হু। তাহলে নিশ্চয় জানো কেন দাঁড়িয়ে থাকি?। হ্যাঁ জানি, কিন্তু সেটা সম্ভব নয়। আমার বুকের বাম পাশটা ছলাৎ করে উঠল। কেন সম্ভব নয়?। নায়লা চুপ করে রইল। জাস্ট এতটুকু বলল, আপনি আর স্টেশন রোডে দাঁড়িয়ে থাকবেন না। কারণ আপনাকে আমার ভালো লাগে না। আর কিছু বলার শক্তি পেলাম না। বৃষ্টির জলের সঙ্গে কখন যে চোখের জল মিশে গেছে বুঝতে পারিনি। নায়লাও আর কোনো কথা বলল না। ওর যা বলার বলে দিয়েছে। নায়লার বাড়ির সামনে নামিয়ে দিয়ে ফিরে আসার সময় নায়লা বলল, এক কাপ চা তো খেয়ে যান। ইচ্ছে হচ্ছিল না তবুও গেলাম, নায়লার মা সব শুনে ধন্যবাদ দিলেন। চা খেয়ে আর দেরি করলাম না।
বের হওয়ার সময় দেখলাম বারান্দা দিয়ে নায়লা আমার দিকে তাকিয়ে আছে। বৃষ্টির মধ্যে বাইক নিয়ে ছুটে চললাম। এরপর অনেক দিন স্টেশন রোডে যায়নি। কেন যেন খুব খারাপ লাগছিল। একা একা থাকতে চাইছলাম। জানালা দিয়ে একলা আকাশ দেখতাম। হঠাৎ একদিন একটি অপরিচিত নম্বর থেকে ফোন এলো। রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে মিষ্টি রিনরিনে গলায় বলল, আমি নায়লা। অপ্রস্তুত হয়ে গেলাম কি বলব বুঝতে পারছিলাম না। আপনি আজ বিকেলে স্টেশন রোডে আসবেন। কেন? বলেছি আসবেন, কি আসবেন না?। আসব। অনেক ধন্যবাদ, ফোনটা রেখে দিল আমাকে আশ্চর্য করে।
৬.
পড়ন্ত বিকেলে একলা দাঁড়িয়ে আছি স্টেশন রোডে দাঁড়িয়ে আছি। কিছুক্ষণ পর একটা রিরশা এসে থামলে কিছুদূর। নায়লা এসেছে, হালকা লালচে রঙের একটা শাড়ি পরে। কপালে বড় একটা টিপ। আমার কাছে এসে বলল, হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছেন কেন চলুন। কোথায়? আজ রেললাইনের পথ ধরে অনেক দূর হেঁটে যাব। মানে?। মানে বুঝতে হবে না। এই বলে নায়লা আমার হাতটা ধরল। তারপর বলল, আমার গোলাপ কোথায়।
আমি হেসে বললাম, সেদিনের পর থেকে আর গোলাপ কিনিনি। বাট আমি কিনেছি, এই বলে নায়লা একটা গোলাপ আমার হাতে দিয়ে বলল, আসলেই তুমি একটা বোকা। আমি না বলেছি বলে আর দাঁড়াবে না, কত কষ্ট হয়েছে তোমাকে না দেখতে পেরে। পড়ন্ত বিকেলে রোদটা আবার এসে পড়েছে নায়লার মুখের ওপর। আর আমার বুকের ভেতর নীরব শিহরণ।
No comments:
Post a Comment