0-3-2015 Daily Somokal-ar Suhriid-a amar lakha golpo>>><<<<<
অনুপমা
সোহানুর রহমান অনন্ত
আমাদের বাড়ির পাশেই কিরণ-মালার দীঘি। কীভাবে এই দীঘির নামকরণ হলো, এই দীঘির বয়সই বা কত, গ্রামের মানুষ বলতে পারে না। দীঘির ওপাশেই হিন্দুপাড়া। সন্ধ্যা হলেই কাঁসর ঘণ্টার শব্দ শোনা যায়। হিন্দুপাড়ার ঠিক মাঝখানেই ছিল অনুপমাদের বাড়ি। বেশ গোছানো একটি পরিবার। অনুপমার বড় ভাই বকুল ঘোষের সঙ্গে ছিল আমার ভালো সম্পর্ক। প্রায়ই দু'জন একসঙ্গে বাজারে মুনসুরের দোকানে বসে চা খাই। বকুলদার সঙ্গে সব সময় একটি রেডিও থাকত। গ্রামের সাধারণ কৃষকেরা সুযোগ পেলেই ধরে বসত রেডিওর খবর শোনার জন্য। দেশের অবস্থা একেবারে ভালো না। পাকিস্তানি বাহিনী নিরীহ বাঙালিদের ওপর গুলি করছে নির্বিচারে। চারদিকে আতঙ্ক।
একেবারে অজো পাড়ার এক গ্রামে জন্ম আমার। তবে এই অজপাড়াগাঁয়েরও একটি সৌন্দর্য রয়েছে। আর তা হলো অনুপমা। পুরো নাম অনুপমা ঘোষ। গ্রামের আট-দশটা মেয়ের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। যেমন গায়ের রঙ তেমন চেহারা। কথা বলার ধরনটাও মিষ্টি। বেশ কয়েকটা বিয়ের সম্বন্ধ এসে ভেঙে গেছে। পাত্র যৌতুক হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। মাঝে মাঝেই বকুলদা আফসোসের সঙ্গে বলে, বোনটার জন্য একখান সুপাত্র পেলাম না! এই বলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি কেবল শুনে যাই, কোনো উত্তর দিই না।
সন্ধ্যা হলেই অনুপমাদের বাড়ি গিয়ে উঠি বকুলদার খোঁজে। আর ঠিক সেই সময়টিতেই চোখাচোখি হয় অনুপমার সঙ্গে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখের পাপড়ি দুটি আর এক হয় না। এক কাপ চা আর মুড়ি খেতেই হয়। অনুপমার বাবা শয্যাশায়ী। এককালে বেশ নাম করা
সোনার ব্যবসায়ী ছিলেন। কালের বিবর্তনে এখন সেসব কিছুই নেই। অনুপমার কাকা নিতাই ঘোষ। মাঝে মাঝে আমাকে দেখলে তাকিয়ে থাকেন। তিনি যে আমার এ বাড়িতে আসা পছন্দ করেন না, সেটা ঢের বোঝা যায় চাহনি দেখে। অবশ্য এতে দোষের কিছু নেই। একজন মুসলিম ছেলে হিন্দুবাড়িতে এলে মানুষ আড়চোখে দেখতেই পারে। সেদিন বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ঘোষবাড়িতে প্রবেশ করলাম। পুরো বাড়ি অন্ধকারে ঢাকা। উঠোনে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকবার বকুলদার নাম ধরে ডাকলাম। কোনো সাড়া-শব্দ নেই। ফিরে যাব কি-না ভাবছি এমন সময় অনুপমা বলে উঠল, দাদা তো সদরে গেছে। আসমানের যা অবস্থা, তাতে আজ আর ফিরবে না বোধ হয়। সদরে দাদার বন্ধু তুষার দত্তের বাড়িতেই থেকে যাবে হয়তো। আমি কিছুই বললাম না। ফিরে যাবার জন্য পা বাড়াব এমন সময় অনুপমা বলল, দাঁড়িয়ে না থেকে ভেতরে এসে বসেন। ভিজে যাচ্ছেন তো। আমি ছাতাটা রেখে ভেতরে গিয়ে বসলাম। অনুপমা একটা গামছা এনে বলল, মাথাটা মুছে নিন, ঠাণ্ডা লেগে যাবে। ওর ঠোঁটের মুচকি হাসিতে ছোট্ট তিলটা নেচে উঠছে। হারিকেনের হালকা আলোয় অনুপমার মুখটা সত্যি বেশ সুন্দর লাগছে। আমি তাকিয়ে রইলাম অপলক দৃষ্টিতে।
২.
বৃষ্টি কমে এলে ছাতাটা নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম। বকুলদা আমাকে দেখে বলল, শুনেছিস?
কী?
পাকবাহিনী নাকি গ্রামের মানুষদের ওপর হামলা শুরু করেছে। কথাটা শুনে চমকে গেলাম আমি। ভেতর থেকে বাবা বেরিয়ে এলেন। সর্বনাশ! এখন কী হবে? বকুলদা আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল, শোন, গ্রাম থেকে অনেকে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং নিতে যাইতাছে। সবকিছু ঠিক করে রেখেছি, আমিও চলে যাব। এখন তুই যাবি কি-না বল? আমি কী করব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। একদিকে অনুপমার ভালোবাসা অন্যদিকে দেশরক্ষা। শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম, আজ রাতেই আমরা ট্রেনিং নিতে চলে যাব। সন্ধ্যায় আর একবার গেলাম
ঘোষবাড়িতে। অনুপমা আজ একটি শাড়ি পরেছে। দেশের এই খারাপ সময়ের মাঝেও অনুপমার মুখটা দেখলে শান্তি পাই। নাহ্; ভালোবাসার কথাটা আর বলা যাবে না অনুপমাকে। আগে দেশ স্বাধীন করি, তারপর বলব। ফেরার সময় একবার তাকিয়েছিলাম অনুপমার দিকে। ঠিক সেদিনের মতো আজও আমার চলে আসার দিকে তাকিয়ে আছে। তবে আজ হাসি নেই। মলিন একটি মুখ। হয়তো অনুপমাও শুনতে চেয়েছিল আমার মুখের না-বলা সেই কথাটুকু। আর তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। মাঝরাতে আমরা বেশ কয়েকজন বেরিয়ে পড়লাম। বাবা অবশ্য বেশ কয়েকবার বলেছেন, দরকার নেই যুদ্ধে যাওয়ার। তার চেয়ে বরং আমরা ইন্ডিয়া চলে যাই। সেখানে আমাদের দুরসম্পর্কের একজন চাচা থাকে। কিন্তু দেশপ্রেমের কাছে সেদিন সবকিছুই মিছে হয়ে গিয়েছিল। অন্ধকারে কিরণ-মালার দীঘির পাড় ধরে আমরা হেঁটে চললাম। দীঘির জলে তখন আধা মেঘে ঢাকা চাঁদটা ভেসে আছে।
৩.
যুদ্ধ চলা অবস্থায় খুব মনে পড়ত অনুপমার কথা। চুপিচপি ঘোষবাড়িতে ঢুকে অনুপমার ঘরের দরজায় টোকা দিলাম।
কে? ফিসফিস করে বললাম, আমি। অনুপমা কণ্ঠ চিনতে পেরে দরজা খুলে দেয়। আমাকে দেখে হয়তো চমকে গেছে। আমি তাকিয়ে রইলাম ভালোবাসার মুখটির দিকে। অনুপমা মুচকি হাসলো।
দাদা কেমন আছে?
ভালো আছে।
আচ্ছা দেশ কবে স্বাধীন হইব?
হবে, খুব তাড়াতাড়ি। একটা কথা ছিল।
কী কথা?
নাহ্, এখন বলব না। যেদিন দেশ স্বাধীন করতে পারব সেদিন বলব।
ততদিনে যদি দেরি হয়ে যায়?
হবে না, আমি ফিরে আসবই। চাঁদের এক টুকরো আলো এসে পড়েছে অনুপমার মুখের উপর। আচ্ছা আমি এখন যাই_ বলে ফেরার জন্য পা বাড়ালাম। এই প্রথম অনুপমার চোখে জল দেখলাম। চাঁদের হালকা আলোয় এক একটি ফোঁটা জ্বলজ্বল করছে। কষ্টটাকে মনে চাপা দিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগলাম। পেছনে আর তাকাতে পারলাম না।
৪.
চারদিকে বিজয়ের খবর শোনা যাচ্ছে। পাকিস্তানি বাহিনী এখন দিশেহারা। তবুও আমরা থেমে না গিয়ে আক্রমণ চালিয়ে গেলাম। অবশেষে শত্রুপক্ষকে শেষ করে স্কুলটি দখল করলাম। স্কুলের প্রতিটি রুমেই অনেক বাঙালির লাশ পড়ে আছে। সবাই একেকটি রুম দেখতে লাগলাম, কেউ বেঁচে আছে কিনা। একটি রুমে ঢুকতেই দেখলাম রুমটা অন্ধকার। হঠাৎ মনে হলো, একটা মানুষের দেহ মেঝেয় পড়ে আছে। পকেট থেকে ম্যাচটা বের করে এক নিঃশ্বাসে কাঠি জ্বালালাম। সামনে যা দেখলাম তাতে আমি কিছুক্ষণের জন্য পাথর। আগুনটা জ্বলতে জ্বলতে আঙুলে এসে আঘাত করেছে। চোখের কোনে বিন্দু বিন্দু জল। অন্ধকারে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। চোখের ভুল নয়তো? আরও একটি কাঠি জ্বালালাম সাহস করে। হ্যাঁ সত্যি। ওই তো আমার অনুপমার অর্ধনগ্ন লাশ পড়ে আছে। নরপিশাচরা শকুনের মতো শেষ করেছে আমার ভালোবাসাকে। হাঁটু গেড়ে বসে কাঁদতে লাগলাম। মনে পড়ে গেল অনুপমার কথা। সত্যি কি দেরি করে ফেললাম আমি?
৫.
চারদিকে চূড়ান্ত বিজয়ের আনন্দ। অনেক রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিরণ-মালার দীঘির জলে পা ভিজিয়ে আমি বসে আছি। দীঘির ওপারে শ্মশানে দাহ করা হয়েছে অনুপমাকে। আমার অশ্রু ঝরে পড়ে দীঘির জলে। বকুলদা এসে পাশে বসল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, এ আমার কী হলো রে ভাই? গ্রামের একজনের মুখে শুনলাম, কিছু রাজাকার জানতে পারে আমি মুক্তিযুদ্ধে গেছি। ব্যস, পাকিস্তানি বাহিনীকে খবর দিয়ে গ্রামে নিয়ে আসে। বাড়ি এসে প্রথমে বাবাকে হত্যা করে এবং অনুপমাকে তুলে নিয়ে যায়। আমি শুনে গেলাম কথাগুলো। কোনো উত্তর দিলাম না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি শ্মশানের দিকে। বকুলদা পাশে কেঁদেই চলল। আমার হৃদয়টাও কাঁদছিল কিন্তুবকুলদা সে কান্না দেখতে পায়নি।
অনুপমা
সোহানুর রহমান অনন্ত
আমাদের বাড়ির পাশেই কিরণ-মালার দীঘি। কীভাবে এই দীঘির নামকরণ হলো, এই দীঘির বয়সই বা কত, গ্রামের মানুষ বলতে পারে না। দীঘির ওপাশেই হিন্দুপাড়া। সন্ধ্যা হলেই কাঁসর ঘণ্টার শব্দ শোনা যায়। হিন্দুপাড়ার ঠিক মাঝখানেই ছিল অনুপমাদের বাড়ি। বেশ গোছানো একটি পরিবার। অনুপমার বড় ভাই বকুল ঘোষের সঙ্গে ছিল আমার ভালো সম্পর্ক। প্রায়ই দু'জন একসঙ্গে বাজারে মুনসুরের দোকানে বসে চা খাই। বকুলদার সঙ্গে সব সময় একটি রেডিও থাকত। গ্রামের সাধারণ কৃষকেরা সুযোগ পেলেই ধরে বসত রেডিওর খবর শোনার জন্য। দেশের অবস্থা একেবারে ভালো না। পাকিস্তানি বাহিনী নিরীহ বাঙালিদের ওপর গুলি করছে নির্বিচারে। চারদিকে আতঙ্ক।
একেবারে অজো পাড়ার এক গ্রামে জন্ম আমার। তবে এই অজপাড়াগাঁয়েরও একটি সৌন্দর্য রয়েছে। আর তা হলো অনুপমা। পুরো নাম অনুপমা ঘোষ। গ্রামের আট-দশটা মেয়ের চেয়ে সম্পূর্ণ আলাদা। যেমন গায়ের রঙ তেমন চেহারা। কথা বলার ধরনটাও মিষ্টি। বেশ কয়েকটা বিয়ের সম্বন্ধ এসে ভেঙে গেছে। পাত্র যৌতুক হিসেবে মোটা অঙ্কের টাকা দাবি করে। মাঝে মাঝেই বকুলদা আফসোসের সঙ্গে বলে, বোনটার জন্য একখান সুপাত্র পেলাম না! এই বলে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। আমি কেবল শুনে যাই, কোনো উত্তর দিই না।
সন্ধ্যা হলেই অনুপমাদের বাড়ি গিয়ে উঠি বকুলদার খোঁজে। আর ঠিক সেই সময়টিতেই চোখাচোখি হয় অনুপমার সঙ্গে। কয়েক সেকেন্ডের জন্য চোখের পাপড়ি দুটি আর এক হয় না। এক কাপ চা আর মুড়ি খেতেই হয়। অনুপমার বাবা শয্যাশায়ী। এককালে বেশ নাম করা
সোনার ব্যবসায়ী ছিলেন। কালের বিবর্তনে এখন সেসব কিছুই নেই। অনুপমার কাকা নিতাই ঘোষ। মাঝে মাঝে আমাকে দেখলে তাকিয়ে থাকেন। তিনি যে আমার এ বাড়িতে আসা পছন্দ করেন না, সেটা ঢের বোঝা যায় চাহনি দেখে। অবশ্য এতে দোষের কিছু নেই। একজন মুসলিম ছেলে হিন্দুবাড়িতে এলে মানুষ আড়চোখে দেখতেই পারে। সেদিন বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ঘোষবাড়িতে প্রবেশ করলাম। পুরো বাড়ি অন্ধকারে ঢাকা। উঠোনে দাঁড়িয়ে বেশ কয়েকবার বকুলদার নাম ধরে ডাকলাম। কোনো সাড়া-শব্দ নেই। ফিরে যাব কি-না ভাবছি এমন সময় অনুপমা বলে উঠল, দাদা তো সদরে গেছে। আসমানের যা অবস্থা, তাতে আজ আর ফিরবে না বোধ হয়। সদরে দাদার বন্ধু তুষার দত্তের বাড়িতেই থেকে যাবে হয়তো। আমি কিছুই বললাম না। ফিরে যাবার জন্য পা বাড়াব এমন সময় অনুপমা বলল, দাঁড়িয়ে না থেকে ভেতরে এসে বসেন। ভিজে যাচ্ছেন তো। আমি ছাতাটা রেখে ভেতরে গিয়ে বসলাম। অনুপমা একটা গামছা এনে বলল, মাথাটা মুছে নিন, ঠাণ্ডা লেগে যাবে। ওর ঠোঁটের মুচকি হাসিতে ছোট্ট তিলটা নেচে উঠছে। হারিকেনের হালকা আলোয় অনুপমার মুখটা সত্যি বেশ সুন্দর লাগছে। আমি তাকিয়ে রইলাম অপলক দৃষ্টিতে।
২.
বৃষ্টি কমে এলে ছাতাটা নিয়ে আবার বেরিয়ে পড়লাম। বকুলদা আমাকে দেখে বলল, শুনেছিস?
কী?
পাকবাহিনী নাকি গ্রামের মানুষদের ওপর হামলা শুরু করেছে। কথাটা শুনে চমকে গেলাম আমি। ভেতর থেকে বাবা বেরিয়ে এলেন। সর্বনাশ! এখন কী হবে? বকুলদা আমাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বলল, শোন, গ্রাম থেকে অনেকে মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং নিতে যাইতাছে। সবকিছু ঠিক করে রেখেছি, আমিও চলে যাব। এখন তুই যাবি কি-না বল? আমি কী করব ঠিক বুঝতে পারছিলাম না। একদিকে অনুপমার ভালোবাসা অন্যদিকে দেশরক্ষা। শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম, আজ রাতেই আমরা ট্রেনিং নিতে চলে যাব। সন্ধ্যায় আর একবার গেলাম
ঘোষবাড়িতে। অনুপমা আজ একটি শাড়ি পরেছে। দেশের এই খারাপ সময়ের মাঝেও অনুপমার মুখটা দেখলে শান্তি পাই। নাহ্; ভালোবাসার কথাটা আর বলা যাবে না অনুপমাকে। আগে দেশ স্বাধীন করি, তারপর বলব। ফেরার সময় একবার তাকিয়েছিলাম অনুপমার দিকে। ঠিক সেদিনের মতো আজও আমার চলে আসার দিকে তাকিয়ে আছে। তবে আজ হাসি নেই। মলিন একটি মুখ। হয়তো অনুপমাও শুনতে চেয়েছিল আমার মুখের না-বলা সেই কথাটুকু। আর তাকিয়ে থাকতে পারলাম না। মাঝরাতে আমরা বেশ কয়েকজন বেরিয়ে পড়লাম। বাবা অবশ্য বেশ কয়েকবার বলেছেন, দরকার নেই যুদ্ধে যাওয়ার। তার চেয়ে বরং আমরা ইন্ডিয়া চলে যাই। সেখানে আমাদের দুরসম্পর্কের একজন চাচা থাকে। কিন্তু দেশপ্রেমের কাছে সেদিন সবকিছুই মিছে হয়ে গিয়েছিল। অন্ধকারে কিরণ-মালার দীঘির পাড় ধরে আমরা হেঁটে চললাম। দীঘির জলে তখন আধা মেঘে ঢাকা চাঁদটা ভেসে আছে।
৩.
যুদ্ধ চলা অবস্থায় খুব মনে পড়ত অনুপমার কথা। চুপিচপি ঘোষবাড়িতে ঢুকে অনুপমার ঘরের দরজায় টোকা দিলাম।
কে? ফিসফিস করে বললাম, আমি। অনুপমা কণ্ঠ চিনতে পেরে দরজা খুলে দেয়। আমাকে দেখে হয়তো চমকে গেছে। আমি তাকিয়ে রইলাম ভালোবাসার মুখটির দিকে। অনুপমা মুচকি হাসলো।
দাদা কেমন আছে?
ভালো আছে।
আচ্ছা দেশ কবে স্বাধীন হইব?
হবে, খুব তাড়াতাড়ি। একটা কথা ছিল।
কী কথা?
নাহ্, এখন বলব না। যেদিন দেশ স্বাধীন করতে পারব সেদিন বলব।
ততদিনে যদি দেরি হয়ে যায়?
হবে না, আমি ফিরে আসবই। চাঁদের এক টুকরো আলো এসে পড়েছে অনুপমার মুখের উপর। আচ্ছা আমি এখন যাই_ বলে ফেরার জন্য পা বাড়ালাম। এই প্রথম অনুপমার চোখে জল দেখলাম। চাঁদের হালকা আলোয় এক একটি ফোঁটা জ্বলজ্বল করছে। কষ্টটাকে মনে চাপা দিয়ে দ্রুত হাঁটতে লাগলাম। পেছনে আর তাকাতে পারলাম না।
৪.
চারদিকে বিজয়ের খবর শোনা যাচ্ছে। পাকিস্তানি বাহিনী এখন দিশেহারা। তবুও আমরা থেমে না গিয়ে আক্রমণ চালিয়ে গেলাম। অবশেষে শত্রুপক্ষকে শেষ করে স্কুলটি দখল করলাম। স্কুলের প্রতিটি রুমেই অনেক বাঙালির লাশ পড়ে আছে। সবাই একেকটি রুম দেখতে লাগলাম, কেউ বেঁচে আছে কিনা। একটি রুমে ঢুকতেই দেখলাম রুমটা অন্ধকার। হঠাৎ মনে হলো, একটা মানুষের দেহ মেঝেয় পড়ে আছে। পকেট থেকে ম্যাচটা বের করে এক নিঃশ্বাসে কাঠি জ্বালালাম। সামনে যা দেখলাম তাতে আমি কিছুক্ষণের জন্য পাথর। আগুনটা জ্বলতে জ্বলতে আঙুলে এসে আঘাত করেছে। চোখের কোনে বিন্দু বিন্দু জল। অন্ধকারে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম। চোখের ভুল নয়তো? আরও একটি কাঠি জ্বালালাম সাহস করে। হ্যাঁ সত্যি। ওই তো আমার অনুপমার অর্ধনগ্ন লাশ পড়ে আছে। নরপিশাচরা শকুনের মতো শেষ করেছে আমার ভালোবাসাকে। হাঁটু গেড়ে বসে কাঁদতে লাগলাম। মনে পড়ে গেল অনুপমার কথা। সত্যি কি দেরি করে ফেললাম আমি?
৫.
চারদিকে চূড়ান্ত বিজয়ের আনন্দ। অনেক রক্তের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন হয়েছে। কিরণ-মালার দীঘির জলে পা ভিজিয়ে আমি বসে আছি। দীঘির ওপারে শ্মশানে দাহ করা হয়েছে অনুপমাকে। আমার অশ্রু ঝরে পড়ে দীঘির জলে। বকুলদা এসে পাশে বসল। কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলল, এ আমার কী হলো রে ভাই? গ্রামের একজনের মুখে শুনলাম, কিছু রাজাকার জানতে পারে আমি মুক্তিযুদ্ধে গেছি। ব্যস, পাকিস্তানি বাহিনীকে খবর দিয়ে গ্রামে নিয়ে আসে। বাড়ি এসে প্রথমে বাবাকে হত্যা করে এবং অনুপমাকে তুলে নিয়ে যায়। আমি শুনে গেলাম কথাগুলো। কোনো উত্তর দিলাম না। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি শ্মশানের দিকে। বকুলদা পাশে কেঁদেই চলল। আমার হৃদয়টাও কাঁদছিল কিন্তুবকুলদা সে কান্না দেখতে পায়নি।
No comments:
Post a Comment