join facebook page

Tuesday, 28 October 2014

যে লিখতে পারে সে আঁকতেও পারে<<< আজ ১৪-১০-২০১৪ দৈনিক সমকালে আমার গল্প নন্দিনী<<< অলংকরনটাও আমার করা>>>

নন্দিনী
সোহানুর রহমান অনন্ত

কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি জানালা দিয়ে ঘরে এসে পড়ল। কাঁসর ঘণ্টার শব্দ শোনা যাচ্ছে পাশের বাড়ি থেকে। এই হিন্দু পাড়ার মধ্যে মুসলিম বাড়ি হিসেবে প্রথমে আমাদের বাড়িটিই নজরে আসে। বাবা সরকারি উঁচু শ্রেণীর চাকরিজীবী, চাকরি করলেও নিজে একটা ব্যবসা করেন আর সেই কারণেই বেশিরভাগ দেশের বাইরে কাটান। পড়াশোনা শেষ করেছি বছরখানেক আগে। বাবার অগাধ সম্পত্তি, একমাত্র ছেলে আমি, তাই তেমন একটা টেনশন নেই। আমাদের নিচতলায় নতুন দম্পতি ভাড়াটিয়া এসেছে। মেয়েটির নাম নন্দিনী, অদ্ভুত মেয়ে। পছন্দ বলতে কিছু নেই। বিয়ে করেছে কি একটা বুড়ো আদমিকে। নন্দিনীকে প্রথম যেদিন দেখি, কেন যেন চোখ ফেরাতে পারছিলাম না। শ্যামলা বর্ণের মেয়েটির টানাটানা চোখ সত্যি পুরুষদের ঘায়েল করার যন্ত্র। বোধ করি নন্দিনীকে একনজর দেখার জন্যই দিনে বেশ কয়েকবার ওপর থেকে নিচে আর নিচ থেকে ওপরে উঠি। কখনও দেখতে পাই কখনও বা পাই না। এটা ভালোলাগা থেকে কি-না জানি না। তবে নন্দিনীকে দেখলে ভালো লাগে। শিহরণ জাগে, বুকের ভেতর কাঁসর ঘণ্টা বাজে।
২.
হাত বাড়িয়ে কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির স্পর্শ নিলাম। নন্দিনী কীভাবে যেন বুঝতে পেরেছে আমি ওকে আড় চোখে দেখি। তাই এখন আর জানালার কাছে তেমন একটা দাঁড়ায় না। আমার খুব কষ্ট লাগে, একটা টান অনুভব করি ওর জন্য। মধ্যরাতে ডুকরে কেঁদে উঠি। কেন এমন হয়? তার উত্তর নন্দিনী। নিজেকে বোঝাতে চাই, একে তো মেয়েটি সনাতন ধর্মাবলম্বী তার ওপর বিবাহিত। কিন্তু মন যে এই শব্দগুলোর বিপরীত। ভালোবাসা কি জাত দেখে হয়? এসব হাজারো প্রশ্ন একাকার হয় মনের মধ্যে। দরজাটা খুলে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে গেলাম। নন্দিনীর ঘরের দরজা হালকাভাবে খোলা তাতে বোঝা যায় না ভেতরের কিছু। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে আবার ওপরে ওঠার জন্য পা বাড়ালাম। পেছন থেকে মিষ্টি একটা শব্দ, শুনুন।
আমি চমকে পেছনে ফিরে তাকালাম। নন্দিনী দাঁড়িয়ে আছে, কপালে বড় একটা টিপ, সিঁদুরের লাল রঙে চোখ জুড়িয়ে যায়। সবশেষে আবার সেই কাজল কালো টানাটানা চোখ। আমি যেন হারিয়ে গিয়েছিলাম। নন্দিনী বলে উঠল, আপনাকে একটা কথা বলি? আমি কেবল মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ-সূচক উত্তর দিলাম। ভাষা যেন হারিয়ে ফেলেছিলাম। অপ্রত্যাশিতভাবে
ই নন্দিনী বলে ওঠে, আপনি কি আমাকে ভালোবাসেন? নন্দিনীর এমন কথায় থতমত খেয়ে যাই। আমার নীরবতা দেখে নন্দিনী মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলল, আপনার চোখে এত ভয় কেন? ভয় পেলে তো ভালোবাসা শক্তি হারিয়ে ফেলে। আরেক টুকরো মিষ্টি হাসি দিয়ে নন্দিনী ঘরের দরজা লাগিয়ে দিল। আর আমি হয়ে গেলাম পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ। সে রাতটায় একটুও চোখের পাতা এক করতে পারিনি। সারাক্ষণ নন্দিনীকে ভেবেছি। অনেকটা বেশি ভেবেছি।
৩.
এরপর থেকে নন্দিনীর সঙ্গে চোখে চোখে প্রেম শুরু হলো। অল্পতে গড়িয়ে গেল অনেক দূর। জেনেছি এই বিয়েতে নন্দিনীর মত ছিল না। নন্দিনীর বাবা-মা জোর করেই এই বুড়োর সঙ্গে বিয়ে দিয়েছে। গ্রামে এমন অনেক কিছুই সম্ভব। সে যাই হোক আমাদের প্রেম যে আমার ফ্যামিলি মেনে নেবে না সেটা খুব ভালো করে জানি আমি। জানে নন্দিনীও। শুধু জানে না ভালোবাসা নামক অদৃশ্য মায়াটি। এক শরতের বিকেলে নন্দিনী আমার হাতে হাত রেখে বলল, চলো আমরা অনেক দূর পালিয়ে যাই। আমি কেবল ওর চোখের দিকে তাকিয়ে বলেছিলাম, কোথায় যাব?। অনেক দূর, যেখানে তোমার আমার মাঝখানে কেউ দেয়াল হতে পারবে না। নন্দিনীর কথাটা অনেক ভালো লেগেছিল। ওর ঠোঁটের কোণের তিলটা ছুঁয়ে বলেছিলাম। হারিয়ে যাব, হারিয়ে যাওয়ার মাঝে, যদি তুমি পাশে থাক। নন্দিনীর সেই মায়াভরা হাসি।
৪.
কয়েক দিন ধরেই নন্দিনীর সঙ্গে দেখা হচ্ছে না। নন্দিনীর স্বামী অসুস্থ, সারাক্ষণ স্বামীর কাছেই থাকে। আমি দাঁড়িয়ে থাকি দরজার ওপাশে, মাঝে মাঝে শুনতে পাই, নন্দিনীর পায়ের শব্দ। কিন্তু নন্দিনীর মুখ দেখতে পাই না। নির্ঘুম রাত কাটে, চোখের কোণে একরাশ জল নিয়ে। শরতের শেষ বিকেলে নন্দিনী ওর স্বামীকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে যাওয়ার জন্য রওনা হয়। ডাক্তারে ওদের ভক্তি নেই, গ্রামের কবিরাজদের দিয়েই নাকি সব রোগ সাড়ানো যায়। আমি তাকিয়েছিলাম নন্দিনীর দিকে। নন্দিনী কেবল একবার তাকিয়েছিল আমার দিকে, জল ছলছল চোখে। তারপর চোখ ফিরিয়ে নেয়। নন্দিনী চলে যায় আর ফেরেনি। কত শরৎ আসে কত শরৎ যায় নন্দিনী আর আসে না। নন্দিনী চলে যাওয়ার পর নন্দিনীর বাবা একবার এসেছিল, ঘর ভাড়া এবং জিনিসপত্র নিয়ে যাওয়ার জন্য। আমি সাহস করে জিজ্ঞেস করেছিলাম নন্দিনীর কথা। উত্তরে শুনেছিলাম, এখান থেকে যাওয়ার পর নন্দিনীর অসুস্থ স্বামী মারা যায়। এবং নন্দিনীর মামা ওকে কলকাতা নিয়ে গিয়ে অন্যত্র বিয়ে দিয়ে দেয়। লোকটি যেমন তাড়াহুড়া করে এলো তেমন তাড়াহুড়া করেই বেরিয়ে গেল। আমি এক পা এগিয়ে নন্দিনী যে ঘরটিতে ছিল সেদিকে তাকালাম। আমার চোখ দিয়ে তখনআমার চোখ দিয়ে তখন বৃষ্টি ঝড়ছিল। মনের মধ্যে থেমে থেমে ভেজে উঠছিল নন্দিনীর মায়ামাখা হাসির শব্দ।


No comments:

Post a Comment